পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পের চুক্তি বাতিল

জ্বালানি বিভাগ থেকে বিপিসিকে চিঠি ।। দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে শেষ হয়নি কাজ ।। ব্যয় নির্ধারণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও ইপিসি ঠিকাদারের মধ্যে পার্থক্য

লুৎফর রহমান কাকন
২৭ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পের চুক্তি বাতিল

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পিতলগঞ্জ থেকে কুর্মিটোলা এভিয়েশন ডিপো পর্যন্ত বিমানের জ্বালানি তেলের পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পের ইপিসি ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। তিন দফা সময় ও প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়েও প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারা এবং নতুন করে আবারও ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবকে অযৌক্তিক মনে করছে জ্বালানি বিভাগ। ফলে চুক্তি বাতিল করে অসামাপ্ত কাজ বাস্তবায়নে নতুন করে টেন্ডার আহ্বানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গতকাল জ্বালানি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট ও কনস্ট্রাকশন (ইপিসি) ঠিকাদার হিসেবে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান নৌ-কল্যাণ ফাউন্ডেশন ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড (এনকেএফটিসিএল) প্রকল্পটিতে কাজ করে আসছিল।

বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বিপিসির যতগুলো প্রকল্প আছে সেগুলোর মধ্যে এই প্রকল্প পুরোপুরি লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি করে ফেলেছেন সংশ্লিষ্টরা। দফায় দফায় সময় এবং ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবু প্রকল্পের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আবারও ব্যয় এবং সময় বৃদ্ধির আবেদন করা হয়েছে। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি করে এর যৌক্তিকতা দেখে একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। একই সঙ্গে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়- ইপিসি ঠিকাদারদের ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা যাচাই করতে। তাতে দেখা যায়, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের হিসাবের চেয়ে ইপিসি ঠিকাদারের ব্যয়ের হিসাব অনেক বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। এই কর্মকর্তা বলেন, তবু কমিটি নানা দিক বিশ্লেষণ করে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিল জ্বালানি বিভাগে। তবে জ্বালানি বিভাগের কাছে সেটা যৌক্তিক না হওয়ায় জ্বালানি বিভাগ চুক্তি বাতিল করে নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করতে বলেছে।

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপো থেকে কুর্মিটোলা এভিয়েশন ডিপো (কেডিএ) পর্যন্ত ট্যাংকলরির মাধ্যমে জ্বালানি তেল পরিবহন করা হয়। তবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেশি-বিদেশি উড়োজাহাজের জ্বালানি তেল সহজ, সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্ন এবং ব্যয় সাশ্রয়ীভাবে পরিবহনের লক্ষ্যে ট্যাংকলরির মাধ্যমে পরিবহন থেকে বেরিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে বিমানের জ্বালানি তেল জেট-১ পরিবহনের লক্ষ্য ঠিক করা হয়। এই লক্ষ্যে রূপগঞ্জের পিতলগঞ্জ থেকে কুর্মিটোলা এভিয়েশন ডিপো পর্যন্ত বিপিসি একটি ৮ ইঞ্চি পাইপলাইন নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর প্রকল্পটির ডিপিপি অনুমোদন হয়। অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৯ সাল পর্যন্ত। পরে প্রথম সংশোধিত ডিপিপি অনুয়ায়ী প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত। নির্ধারিত সময়ে কাজে তেমন অগ্রগতি না থাকায় পরে ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। সর্বশেষ ২০২১ সালের ৯ নভেম্বর অনুমোদিত আরডিপিপি (২য় সংশোধিত) অনুযায়ী প্রকল্প ব্যয় ৩৩৯ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে বাস্তবায়ন মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে প্রকল্পের আওতায় পিতলগঞ্জ থেকে কেডিএ পর্যন্ত ১৫ দশমিক ২১ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন, পিতলগঞ্জে জেট-এ-১ ডিপো, তিনটি স্টোরেজ ট্যাংক, পাম্পিং ফ্যাসিলিটিজ, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরসংলগ্ন একটি ছোট জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া কেডিএ কন্ট্রোল বিল্ডিং, পাম্পিং ফ্যাসেলিটিজ, ভেসেলসহ স্টোরেজ ট্যাংকে অটো ট্যাংক গেজিং সিস্টেম নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ এ সময়ের মধ্যে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০-এর আওতায় উক্ত প্রকল্প বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট ও কনস্ট্রাকশন (ইপিসি) ঠিকাদার হিসেবে অনুমোদন পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে নৌবাহিনীর সঙ্গে ‘টার্ন কি’ ভিত্তিতে প্রথমে ১৮৩.৩৪ কোটি টাকার ইপিসি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পক্ষে নৌবাহিনীর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান নৌ-কল্যাণ ফাউন্ডেশন ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড (এনকেএফটিসিএল) বাস্তবায়ন করে। পরবর্তী সময়ে এনকেএফটিসিএলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ আইন ২০১৮-এর আওতায় নৌবাহিনীর সঙ্গে ২৬৭ দশমিক ৪৭ কোটি টাকার সংশোধিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে প্রকল্পের মোট চুক্তি মূল্য দাঁড়ায় ৩৩৯ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা।

এ অবস্থায় আবারো ব্যয় বৃদ্ধির আবেদন করে ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ইপিসি ঠিকাদার কর্তৃক প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে রাখা হয়। পরবর্তীতে জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে ইপিসি ঠিকাদারের কাছে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হলে ডলারের মূল্য বৃদ্ধিসহ নানাবিধ যুক্তি তুলে প্রকল্পের ব্যয় ১৪৮ শতাংশ বৃদ্ধির আবেদন করে সংশোধিত চুক্তিমূল্য ৬৫০ দশমিক ৮৯ কোটি টাকা বৃদ্ধি এবং ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে আরও ২৪ মাস বৃদ্ধির আবেদন করে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, খরচ বাড়ানোসহ সংশোধিত চুক্তি সম্পাদনে অনুমোদনের জন্য নতুন প্রস্তাব বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন থেকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় হয়ে গত বছরের জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয় থেকে প্রকল্পটির বিষয়ে বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণসহ বিপিসির কাছে সুনির্দিষ্ট মতামত চাওয়া হয়।

পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডোর্সচ কনসালটেন্ট ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের (ভারত) সহায়তায় ডোর্সচ হোল্ডিং জিএমবিএইচ জার্মানির মাধ্যমে অবশিষ্ট কাজ শেষ করার লক্ষ্যে অসমাপ্ত কাজের বিবরণসহ একটি প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করতে বলেন। সেখানে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ব্যয় নির্ধারণ করে ২৫০ কোটি ৮০ লাখ টাকার মতো। তবে ইপিসি ঠিকাদার আরও বেশি ব্যয় নির্ধারণ করে। পরে বিপিসির পরিচালককে (অপারেশন ও পরিবহন) আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। এ কমিটি ইপিসি ঠিকাদার, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এবং পদ্মা অয়েল কোম্পানির সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে প্রকল্পের ব্যয় ৫৭৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করে। এছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ৩৬ মাস বৃদ্ধি করে ২০২৫ সাল পর্যন্ত করার সুপারিশ করে। তবে জ্বালানি বিভাগ ইপিসি ঠিকাদারের কাজে অদক্ষতা ও ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করে নতুন করে টেন্ডার আহ্বানের নির্দেশ দিয়েছে।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগের একজ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘জেট এ-১ পাইপলাইন ফ্রম পিতলগঞ্জ (নিয়ার কাঞ্চনব্রিজ) টু কুর্মিটোলা এভিয়েশন ডিপোর ইনক্লুডিং পাম্পিং ফ্যাসিলিটিজ অ্যান্ড জেটি’ শীর্ষক এই প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করার একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল। সেটা হলো- সরকারের নতুন করে নির্মিত এয়ারপোর্টের সঙ্গে বিমানের জ্বালানি তেল পরিবহন ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন করা। কিন্তু এ প্রকল্পটি এতটাই বাজে অবস্থায় আছে যে, জ্বালানি বিভাগও হতাশ হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করে দ্রুত কাজটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে। তবে এটাও এখন সময়সাপেক্ষ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।