আওয়ামী লীগের রাজনীতির বাঁকবদল

আবুল মোমেন
২৩ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
আওয়ামী লীগের রাজনীতির বাঁকবদল

বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ যে আশা ও ভরসা নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন তথা পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে, তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে কোনো নজর দেওয়াই তারা (মুসলিম লীগ নেতারা) দরকার মনে করল না। জমিদার ও জায়গিরদাররা যাতে শোষণ করতে পারে সে ব্যাপারেই সাহায্য দিতে লাগল। কারণ এই শোষক লোকরাই এখন মুসলিম লীগের নেতা এবং এরাই সরকার চালায় (পৃ. ২৪১)।’ ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় পর পরই প্রদেশের সংগঠক ও কর্মীরা কেন্দ্র ও মুসলিম লীগ নেতাদের ভূমিকায় ভীষণভাবে হতাশ হয়েছিলেন। এটা কেবল তরুণ বঙ্গবন্ধুর ভাবনাই নয়, আরও অনেকেই তার মতো হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তবে তরুণ শেখ মুজিবের দূরদর্শী চিন্তা ও সাংগঠনিক দক্ষতার কথা ছিল সুবিদিত। তিনি তখন থেকেই নতুন দল গঠনের কথা ভেবেছিলেন। তারা জমিদার, জায়গিরদার, নবাবজাদাদের খপ্পর থেকে দলটি মুক্ত করে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ ও সাধারণ জনগণের দলে রূপান্তরের কাজ করলেন। তারা গঠন করলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। অর্থাৎ সরকারি মুসলিম লীগ হলো জমিদার-জায়গিরদার-নবাবজাদা-পীরজাদাদের আর তাদের মুসলিম লীগ হলো আমজনগণের- তাই এ দলের নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৪৯ সালে গঠিত দলের সভাপতি করা হয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে এবং সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় পাকিস্তান আন্দোলনের তুখোড় কর্মী শামসুল হককে। শেখ মুজিব হলেন যুগ্ম সম্পাদক।

ভাষা আন্দোলনের সময় এ বাংলার জনগণ মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে আরও দূরে সরে যায়। শুরুতে এটা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষিত ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় সারা প্রদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ভাগাবেগের সৃষ্টি হয়। এ আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনায় সমৃদ্ধ। এ সময়ে পূর্ববাংলার বুদ্ধিজীবী ও তাদের দেখাদেখি সাধারণ মানুষের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত হয়। এই ভাবাবেগের জেরে ১৯৫৪-র প্রাদেশিক নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ের গুরুত্ব ছিল বেশি আর এবার মানুষের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার পরিচয় পেল প্রাধান্য। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সমাজচেতনার এই পরিবর্তন নিশ্চয় খেয়াল করেছিলেন। তারা উপলব্ধি করেন গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ধর্মীয় পরিচয় নয়, মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক পরিচয়ের গুরুত্ব বেশি। এবার আওয়ামী লীগ দলের নাম থেকে ধর্মীয় পরিচয় মুছে ফেলল। দলের নাম হলো ¯্রফে আওয়ামী লীগ। আগে আওয়ামী শব্দটি মুসলিমের বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এবার এটিই বিশেষ্যে পরিণত হলো।

গত শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষদিক থেকে ষাটের দশকজুড়ে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের পক্ষে জনজোয়ার তৈরি হয়েছিল। বিশেষত দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামে ছিল বামপন্থিদের প্রাধান্য এবং সমাজতন্ত্র ছিল তাদের স্বাধীন দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্যাদর্শ। বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে যদিও আত্মজীবনীতে নিজেকে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বলেছেন (দ্রষ্টব্য. পৃ. ২৩৪) তবে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন দলে অনেকটাই পাকিস্তানের মার্কিন ঘেঁষা নীতি অনুসৃত হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু এবং আইয়ুবের সামরিক শাসন কিছুটা শিথিল করে রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবনের সুযোগ দেওয়া হলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে আবিভূর্ত হয়। এ সময় থেকে বঙ্গবন্ধু দলের মূল কাণ্ডারি হয়ে ওঠেন এবং দ্রুত তারা রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সাংগঠনিক দক্ষতার মাধ্যমে প্রদেশের রাজনীতির মধ্যমণি হয়ে ওঠেন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণা, পরবর্তীকালে ছাত্রদের ১১ দফাকে গ্রহণ এবং সর্বশেষ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় সমাজতন্ত্র যে তার রাজনৈতিক দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ তা স্পষ্টই হয়েছিল। হয়তো বলা যাবে বঙ্গবন্ধু, তার সহযোদ্ধা তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেক নেতাকর্মী এতে বিশ্বাসী হলেও দলে খন্দকার মোশতাকের মতো অনেকেই ছিলেন, যারা ছিলেন দক্ষিণ পন্থায় বিশ্বাসী। দলের এই বাঁকবদল বাস্তব এবং দল ও দেশের লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, তাই একে রাজনৈতিক সৃজনশীলতাও বলা যেতে পারে।

পঁচাত্তরের হত্যাকা-ের পর আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের সংকট দেখা দেয়। এমনকি তখনকার দলাদলি বা দলের ভাঙন থেকে বোঝা যায় সংকট কেবল নেতৃত্বের নয়, আদর্শ ও নীতিরও রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এসে দলের ঐক্য রক্ষা করলেও ততদিনে দেশে, মুসলিম বিশ্বে এবং বিশ্বব্যাপী নানারকম পরিবর্তন ঘটেছে। জিয়া-এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশ থেকে প্রচুর আর্থিক সাহায্যের ওপর ভর করে এ দেশে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ও ধর্মভিত্তিক আরও দলের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছিল। তার ওপর সত্তর দশকে মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের সমৃদ্ধিতে সেসব দেশে নানান উন্নয়ন কাজ শুরু হয় এবং তাতে প্রথমবারের মতো এ দেশের নিম্নবর্গের মানুষ আরব ভূখণ্ডে যাওয়ার সুযোগ পায়। তাদের সামনে আরবি বা তাদের বিচারে প্রকৃত ইসলামি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগুলো ধরা দেয়। তারা দেশে এর প্রচলনে উৎসাহী হয়। একদিকে ধর্মভিত্তিক দলের প্রচারণা ও সাংগঠনিক তৎপরতা, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে আরবি সংস্কৃতি প্রসারের চেষ্টার ফলে বৃহত্তর সমাজে এক ধরনের নীরব সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটতে থাকে। এ সময় মুক্তবাজার অর্থনীতির রমরমা শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। সমাজতন্ত্রের জোয়ার বন্ধ হয়ে ভাটার টান ততদিনে শুরু হয়ে যায়। এ দেশেও সেই থেকে বামপন্থি রাজনৈতিক দল ও সমাজের বাম প্রগতির ধারা দুর্বল হতে থাকে। এ রকম একটা সময়ে ১৯৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় ঘটে। এটা ছিল তাদের জন্য অপ্রত্যাশিত, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও ফলাফল এমন হবে তা ভাবেননি। দুই সামরিক শাসকের আমলের নির্বাচন এবং ’৯১-এর মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচনে দেখা গেল এ দেশের মানুষের মধ্যে এখনো পাকিস্তানি ধারার মানসিকতা যথেষ্ট শক্তিশালী। তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের প্রতি দুর্বলতা এবং ভারতবিরোধী চেতনাও যথেষ্ট শক্তিশালী। বিএনপি জনগণের এই দুর্বলতাকে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছিল।

দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বুঝেছে যে, ভালো কিছু করতে হলে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি বা দেশের উন্নয়ন হোক বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবার ফিরিয়ে আনা হোক, হোক বঙ্গবন্ধু বা অন্যান্য হত্যাকা-ের বিচারের ইস্যু- এসব বাস্তবায়নে আগে চাই দলকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা। এবার বিরোধীদের সমালোচনার মুখ বন্ধ করতে আওয়ামী লীগ নিজেরাই রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনল, দলের অভ্যন্তরীণ ইসলামচর্চাকে দৃশ্যমান করে তুলল এবং বেশ কিছু ধর্মব্যবসায়ী দলের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করল।

জামায়াত ও তাদের সমমনা বন্ধুরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্বে না থেকে সমাজ রূপান্তরের কাজে মনোযোগ দিয়েছে এবং তারা সে কাজে সফল হয়েছে। আজ আওয়ামী লীগসহ বৃহত্তর সমাজের বড় অংশ বাঙালি সংস্কৃতিচর্চা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে।

পঁচাত্তর বছরের ঐতিহ্যবাহী এই দলের যাত্রাপথ মসৃণ ছিল না, উত্থান-পতন হয়েছে, অনেক বাঁকবদলও ঘটেছে। কিন্তু সে যা-ই হোক, আওয়ামী লীগের লক্ষ্য তো যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা হতে পারে না। কারণ ইতোমধ্যে রাষ্ট্র, সরকার এবং সমাজে আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিশিষ্ট স্বকীয় কোনো ছাপ দেখা যায় না। বাইরে থেকে মনে হচ্ছে সরকার উত্তরোত্তর সামরিক-বেসামরিক-আধাসামরিক আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ধনিক গোষ্ঠী, যার মধ্যে লুটেরা ধনীরাও রয়েছে, তারাও সরকারের বা ক্ষমতার ভেতর মহলের মানুষ হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতিকে রাজনীতির সৃজনশীলতা বলার উপায় নেই, একে আপস বলা যেতে পারে। এই যে আমলাতন্ত্র, ধর্মব্যবসায়ী এবং লুটেরা ধনীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, অনেক ক্ষেত্রে নির্ভরতা, তাতে সরকারসহ সমাজে জবাবদিহিতাবিহীন ক্ষমতাচর্চার সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। অথচ গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিচর্চা ও গণতন্ত্রের বিকাশে আওয়ামী লীগেরই ভূমিকা থাকার কথা সর্বাগ্রে। কিন্তু এই আমলে প্রগতি ও সংস্কৃতির সংকট গভীর হয়েছে। গভীর হয়েছে রাজনীতি ও গণতন্ত্রের সংকট।

পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে আওয়ামী লীগ আশা করি, কেবল উদযাপনের ডামাডোলের মধ্যেই কাটাবে না, তারা আত্মসমালোচনা করবে এবং মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা অসাম্প্রদায়িক উদার মানবিক গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঠিক রাজনীতি খুঁজে নেবে। এটা দলের প্রতি, দেশের প্রতি, জনগণের প্রতি এবং ইতিহাসের প্রতি আওয়ামী লীগের নৈতিক দায় এবং এটাই তাদের আদর্শিক দায় হওয়া জরুরি।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়