সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি, আতঙ্কে নদী তীরের মানুষ

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
১৮ জুন ২০২৪, ২২:৩৫
শেয়ার :
সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি, আতঙ্কে নদী তীরের মানুষ

‘২০২২ সালে বন্যার পানিতে শহরের সব বাসা-বাড়ি তলিয়ে অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল। দুই বছরের মাথায় আবারও সেই বন্যার দেখা দিয়েছে। হটাৎ করে নদীর পানি হু হু পানি বেড়ে কয়েক ঘণ্টায় মধ্যেই বাসায় হাঁটু পানি হয়ে গেছে। স্ত্রী ও মেয়েকে দ্রুত ভাইয়ের বাসায় নিয়ে যাই।’ 

বন্যাকবলিত হয়ে আজ মঙ্গলবার বিকেলে এভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছিলেন সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘরের নদী তীরের বাসিন্দা বাবলু বর্মন। তিনি আরও বলেন, ‘মাত্র দুই বছর আগে ২০২২ সালে জীবনের সবচেয়ে বড় বন্যা দেখলাম। ভাবছিলাম এত বড় বন্যা মনে হয় আর জীবনে হবে না। কিন্তু দুই বছরের মাথায় আবারও সেই ভয়াবহ অবস্থা দেখা দিয়েছে। এভাবে বন্যা হলে সুনামগঞ্জ শহরে বসবাস করা কঠিন হবে।’

মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে আবারও বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া নিয়ে করণীয় বিষয়ে গবেষণা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললেন সুনামগঞ্জ সদর আসনের সংসদ সদস্য পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক। আজ মঙ্গলবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন তিনি। 

প্রেস ব্রিফিংয়ে ড. মোহাম্মদ সাদিক বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনো খাবার, ওষুধপত্র বা স্যালাইন পৌঁছানো ব্যবস্থা করা হয়েছে। রান্না করা খাবার বিতরণে প্রস্তুতি নিচ্ছি। যারা আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে পারেননি তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হবে। বন্যা পরিস্থিতি ও সরকারি বরাদ্দের বিষয়ে ত্রাণ মন্ত্রণালয়েও কথা বলেছি। 

প্রত্যেক বছর সুনামগঞ্জ বন্যা আক্রান্ত হচ্ছে উল্লেখ করে ড. মোহাম্মদ সাদিক আরও বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টির বিষয়ে সবাইকে নিয়ে বসে সভা, সেমিনার, গবেষণা করে আমাদের করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে। আমি জানি ২০২২ সালের বন্যার পর থেকেই সবাই আতংকে থাকেন। সুনামগঞ্জের মানুষকে নিরাপদ রাখার জন্য যা যা করার দরকার তার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

জানা যায়, সুনামগঞ্জের বন্যাপরিস্থিতির সোমবার রাত থেকে অবনতি হয়েছে। আজ মঙ্গলবার ভোর থেকে হু হু করে পানি বাড়তে শুরু করে। সুরমা নদীর পানি সকালে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। পরে বিকেলে ৮ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়েছে। তবে সুরমা নদীর ছাতক উপজেলা সদরে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, সন্ধ্যায় ১৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সুনামগঞ্জে গত ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার সকাল ৯টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৯টা) বৃষ্টি হয়েছে ৬৭ মিলিমিটার। তবে সুনামগঞ্জের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হয়েছে ৩৯৫ মিলিমিটার। যে কারণে উজান থেকে ব্যাপক পরিমাণে পাহাড়ি ঢল নামছে এবং সুনামগঞ্জের নদীগুলোর পানি বাড়ছে। কয়েক উপজেলার লাখো মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। তবে হাওর এলাকায় এখনও বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। 

তবে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলার দু’টি পৌরসভাসহ ৭৭ ইউনিয়নের ৭৮১ টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিত লোক সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৭ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এরমধ্যে ছাতক উপজেলায় ৫ হাজার। 

২০২২ সালের জুন মাসে সুনামগঞ্জ ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সুনামগঞ্জে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। তলিয়ে গিয়েছিল পুরো জেলা। মাছ চাষের সব পুকুর পানিতে ভেসে গিয়েছিল। রাস্তা-ঘাট-কালভার্ট ভেঙে যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কয়েক লাখ মানুষ। ঘরবাড়ি হারিয়েছিল অর্ধলক্ষাধিক পরিবার। যদিও সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হয়েছিল। 

স্মরণকালের বন্যার ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর মাত্র দুই বছরের মাথায় সেই জুন মাসেই আবারও বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি ২০২২ সালের পর্যায়ে না গেলেও জেলার সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও জগন্নাথপুর উপজেলার অবস্থা অবনতি হচ্ছে। অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যা কবলিত এলাকার লোকজন আশপাশের উঁচু জায়গা ও সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন। বন্যার পানিতে ছাতক-সিলেট সড়ক, সুনামগঞ্জ-সাচনাবাজার সড়ক, সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়ক, সুনামগঞ্জ-দোয়ারাবাজার সড়ক, সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর সড়ক প্লাবিত হওয়ায় এসব সড়ক দিয়ে সরাসরি যান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। 

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, ‘এখানের বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে। সুনামগঞ্জে বৃষ্টি না হলেও চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হলে সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পায় এবং পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। আরও কয়েকদিন মাঝারি ও ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে নদীর পানি বৃদ্ধি হতে পারে।’

কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ দৈনিক আমাদের সময়কে আজ রাতে জানিয়েছেন, আজ রাত ১২ টার পর থেকে আবার সুনামগঞ্জসহ সিলেট বিভাগের ওপরে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়ে আগামীকাল বুধবার দুপুর পর্যন্ত চলার আশংকা করা যাচ্ছে। ভারী বৃষ্টি আগামী ২১ জুন পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তাই এই অঞ্চলের মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে।’ 

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুনামগঞ্জ জেলায় ৫৩১ টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বেশ কিছু আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন এসেছেন। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন তাদেরকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর ও জগন্নাথপুরে ৫ টন করে জি.আর চাল দেওয়া হয়েছে। ৬০০ টন জি.আর চাল মজুদ রয়েছে। শুকনো খাবার, শিশু খাদ্য ও গো-খাদ্যের জন্য আমরা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি। মঙ্গলবার পর্যন্ত বিভিন্ন উপজেলায় নগদ ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।’