বেনজীরের সম্পদ জব্দের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে

তাবারুল হক
১৫ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বেনজীরের সম্পদ জব্দের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে

ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে একের পর এক সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে দুদকের অনুসন্ধানে আলোচিত এ পরিবারের নামে দেশের ৬টি জেলায় ৭০২ বিঘা জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া রাজধানীতে বহুতল ভবন, ১২টি ফ্ল্যাট, ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ২৫টি কোম্পানিতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের সন্ধান পেয়েছে দুদক। তিন দফায় আদালতের নির্দেশনা পেয়ে এসব সম্পদ জব্দও করেছে দুদক।

দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বেনজীর পরিবারের নামে ঢাকা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কক্সবাজার, গাজীপুর, পার্বত্য জেলা বান্দরবানে থাকা সম্পত্তির

সন্ধান পাওয়া গেছে। আরও বেশকিছু জেলায় এই পরিবারের নামে সম্পত্তি রয়েছে বলে সন্দেহ করছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তারা। এসব সম্পত্তির তথ্য জানাতে দেশের বিভিন্ন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ইতোমধ্যে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কোনো সম্পত্তি পাওয়া গেলে সেগুলোও জব্দ করা হবে বলে জানান তারা।

জব্দের বাইরে থাকা সম্পত্তি : গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে ইতোমধ্যে বেনজীর আহমেদের নামে নীলফামারী ও ঠাকুরগাঁওয়ে ৬০ একর জমির ওপর যৌথ মালিকানায় ফার্ম প্রতিষ্ঠা করার অভিযোগ উঠেছে। স্বাস্থ্য খাতের বিতর্কিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর সঙ্গে যৌথভাবে এসব প্রতিষ্ঠান করেছেন বেনজীর। মিঠু বিরুদ্ধেও শত শত কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান করছেন দুদক। ইতোমধ্যে তার প্রায় ৭৪ কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়ে সেগুলো জব্দ করা হয়েছে।

এদিকে বেনজীর আহমেদের নামে ঢাকায় আরও প্লট-ফ্ল্যাট এবং গাজীপুরে ৪০ বিঘা সম্পত্তি থাকার সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। এসব সম্পত্তি দলিলপত্রে হস্তান্তরিত হওয়ার তথ্য পেয়ে সেগুলো আপাতত জব্দের তালিকায় আনা হয়নি বলে দুদকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

ঢাকা মহানগর বিশেষ জজ আদালতে দুদকের দায়িত্বরত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর আমাদের সময়কে বলেন, ‘বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের যে অভিযোগ, সে বিষয়ে অনুসন্ধান এখনো শেষ হয়নি। এই পরিবারের মোট কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ না হলে বলা মুশকিল। আরও বেশকিছু সরকারি দপ্তরে কমিশন থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর জবাব আসুক, যদি আরও সম্পদের হদিস পাওয়া যায় সেগুলো আদালতে তুলে ধরা হবে, জব্দ করার নির্দেশনা চাওয়া হবে।’

পাঁচ জেলায় সম্পত্তি : এ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বেনজীর আহমেদ, স্ত্রী জীশান মীর্জা ও তিন মেয়ের নামে ২০৫টি দলিলে থাকা ৭০২ বিঘা জমি (৩৩ শতকে এক বিঘা হিসাবে), ৩৩টি ব্যাংক হিসাব ও ২৫টি কোম্পানিতে বিনিয়োগ রয়েছে বলে সন্ধান পায় দুদক। এরপর গত ২৩ ও ২৬ মে এবং ১২ জুন আদালতের নির্দেশে এসব সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করা হয়।

আদালতের নথি থেকে জানা যায়, বেনজীর পরিবারের সম্পত্তির মধ্যে বড় অংশ রয়েছে নিজের জেলা গোপালগঞ্জের তিনটি উপজেলায়। সেখানে ৬৫টি দলিলে ২৪০ বিঘা জমি রয়েছে। গোপালগঞ্জের সদর উপজেলায় বিশাল এলাকাজুড়ে তিনি ‘সাভানা ইকো রিসোর্ট ও ন্যাচারাল পার্ক’ গড়েছেন। এ ছাড়া পাশর্^বর্তী জেলা মাদারীপুরের রাজৈরে স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে ১১৩টি দলিলে প্রায় ২৮০ বিঘা জমি কিনেন।

এদিকে দেশের ছোট প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে (৮ বর্গকিলোমিটার) বেনজীর নিজের নামে পাঁচটি দলিলে পৌনে দুই একর জমি কিনে রেখেছেন। ইনানী সমুদ্রসৈকতে বেনজীরের স্ত্রী নামে প্রথম ৪০ শতাংশ জমি কেনার রেকর্ড পাওয়া যায়। এ ছাড়া রাজধানীর গুলশানে এক দিনেই ৯ হাজার ১৯৩ বর্গফুটের চারটি ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। বাড্ডায় রূপায়ণ মিলিনিয়াম স্কয়ারের আটতলায় দুটি বাণিজ্যিক ফ্ল্যাট, আদাবরে পিসিকালসার হাউজিংয়ে ছয়টি ফ্ল্যাট রয়েছে।

এ ছাড়া বেনজীর পরিবারের নামে উত্তরায় ৩ কাঠা প্লটের ওপর বহুতল ভবন, রূপগঞ্জে আনন্দ হাউজিং সোসাইটিতে ৬ কাঠার চারটি প্লট রয়েছে। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান সদরে বিভিন্ন স্থাপনাসহ ২৫ একর জমি রয়েছে। অন্যদিকে, এই পরিবারের নামে ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ২৫টি কোম্পানিতে বিনিয়োগ রয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে কোনটি পরিবারের সদস্যদের নামে শতভাগ ও আবার কোনোটিতে আংশিক বিনিয়োগ করেন বলে তথ্য উঠে এসেছে।

২০১৫ সালে বেনজীর আহমেদ এলিট ফোর্স র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগের বছর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সম্পদ কেনা শুরু করেন। তখন তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। সাড়ে চার বছর র‌্যাবের নেতৃত্ব দেওয়ার পর ২০২০ সালে আইজিপি দায়িত্ব আসেন বেনজীর। প্রায় আড়াই বছর এ দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এসব সম্পত্তি কিনেন তিনি।

বেনজীর আহমেদ ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি র‌্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। ‘গুরুতর’ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তর। ওই তালিকায় র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে বেনজীর আহমেদের নামও আসে।

প্রসঙ্গত, বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানের অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের সংবাদ গণমাধ্যমে আসার পর অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে গত ১৮ এপ্রিল অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।