নানা চাপে আঁটসাঁট বাজেট
দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সব শ্রেণি পেশার মানুষ কষ্টে আছে। ডলার সংকটে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও রিজার্ভে চাপ তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থতির মধ্যেই আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিত্যপণ্য ও সেবার ওপর বাড়তি কর আসছে। এমন কি, মানুষের জীবনধারণ ব্যয়বহুল হয়ে পড়লেও বাড়ছে না করমুক্ত আয়সীমা। এ সব বিষয় সামনে রেখে আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তবে বাজেটের আকার প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না। নতুন বাজেটের আকার ধরা হচ্ছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৪ দশমিক ২০ শতাংশ। জিডিপির অনুপাতে, এটি গত এক দশকে সবচেয়ে ছোট বাজেট। চলতি বছরের তুলনায় মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। অথচ গত পাঁচ বছরে প্রতিবারই বাজেট বৃদ্ধির হার ছিল গড়ে ১১ শতাংশ। এমনকি করোনা মহামারী চলাকালেও বাজেটের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৯ শতাংশ।
জানা গেছে, সরকারের দায়দেনা অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে অবস্থান পাকাপোক্ত করছে। ক্রমবর্ধমান দায়দেনা পরিস্থিতি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতি চোখ রাঙাচ্ছে। শুধু বিদেশি ঋণ নয়, দেশের অভ্যন্তর থেকে নেওয়া ঋণও সরকারের দায়দেনা বাড়িয়ে চলেছে। বাজেটে অর্থের জোগান দিতে সরকারকে এখন আগের চেয়ে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে। ফলে বাড়ছে ঋণ পরিশোধের চাপ। পাশাপাশি ডলার সংকট ও ডলারের বাড়তি দাম সরকারকে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে আরও বেশি চাপে ফেলেছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ চলতি অর্থবছরের চেয়ে কমিয়ে প্রাক্কলন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব করা হচ্ছে, তাতে ঘাটতিই থাকবে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এই বিশাল পরিমাণ ঘাটতি পূরণে কয়েকটি খাতকে উৎস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। এই খাত থেকে মোটা দাগে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে। এর বাইরে বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য বিদেশ থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার সহায়তা পাওয়া যাবে বলেও ধরে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণও রয়েছে। এর পাশাপাশি ব্যাংকবহির্ভূত খাত হিসেবে বিবেচিত সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া হবে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে যা ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ শতাংশ। নতুন রাজস্ব প্রাপ্তির মধ্যে বরাবরের মতো এবারও বেশির ভাগ আয় করার দায়িত্বটি থাকবে জাতীয়
রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে এনবিআরকে রাজস্ব আয়ের টার্গেট
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
দেওয়া হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। নন-এনবিআর থেকে আসবে আরও ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তির টার্গেট থাকছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। পরে তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়। তবে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে বড় জোর ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রায় কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। নতুন অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। যদিও সংশোধিত বাজেটে ১৮ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে এডিপির আকার করা হয় দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
রিজার্ভ সংকট, ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি ও শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির গতি মন্থরতার মধ্যে আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এমন অবস্থায় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর-ব্যবস্থা থেকে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অতিরিক্ত ৭০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের প্রত্যাশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়, যা অর্জন করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
নতুন অর্থবছরে সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ খুব বেশি না বাড়লেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি। এ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, রাজস্ব আহরণ সম্ভব না হলেও আগামী অর্থবছরও ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে না। চলতি অর্থবছরের মতো বার্ষিক করমুক্ত সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকাই থাকছে। তবে করহার পুনর্বিন্যাস হচ্ছে। এখন ৫, ১০, ১৫, ২০ ও ২৫ শতাংশ করহারের সঙ্গে ৩০ শতাংশের আরেকটি স্তর আসছে। বছরে আয় সাড়ে ৩৮ লাখ টাকার বেশি হলে করদাতাকে বাকি অর্থের ওপর ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। তবে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থকে বৈধ করার ঢালাও সুযোগ দেওয়া হতে পারে বাজেটে।
এদিকে বাজেটে সরকারি-বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ৩৩ দশমিক ৭০ শতাংশে উন্নীত হওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত চলতি অর্থবছরের জিডিপির সাময়িক হিসাবের সার-সংক্ষেপ অনুযায়ী চলতি অর্থবছর জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের হার ৩০ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অবাস্তব। কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে না। এটি করতে হলে সুদের হার কমাতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কর্মকা-ে মূল্যস্ফীতি তৈরি হচ্ছে। বিনিয়োগের গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছে না প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। রাজস্ব আহরণের উচ্চাভিলাসী লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না। কারণ দেশের অর্থনীতি এখন নিম্নমুখী। করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না। এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। তিনি বলেন, উচ্চ লক্ষ্যমাত্রার কর আয় করতে সবার ওপর কর দেওয়া হচ্ছে। এতে মানুষ আগামীতে চাপে থাকবে।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানিপণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রান্তিক মানুষের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবারের বাজেটে অগ্রাধিকার। নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে।