কেন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হলেন মোদি
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি। সরকার গঠনের জন্য লোকসভায় ন্যূনতম ২৭২ টি আসন প্রয়োজন হয়। সেখানে বিজেপি পেয়েছে ২৪০টি। ফলে এককভাবে সরকার গঠনের সুযোগ নেই তার। এনডিএ জোটের অন্যান্য শরীকদের নিয়ে সরকার গঠন করতে হবে তাকে। অথচ নির্বাচনি প্রচারে মোদি বারবার ঘোষণা দিচ্ছিলেন যে এবার ৪০০ আসনের বেশি পাবে এনডিএ।
গতকাল মঙ্গলবার ভারতে লোকসভা নির্বাচনের ভোটগণনা শেষে দেখা যায়, নরেন্দ্র মোদির বিজেপি নেতৃত্বধীন এনডিএ ২৯৩ আসনে জয় পেয়েছে। তবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে পারেনি বিজেপি। তাদের আসন সংখ্যা ২৪০টি। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন অন্তত ২৭২টি আসন। তাই সরকার গঠনের জন্য শরীকদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে বিজেপিকে।
২০০২ থেকে। গুজরাটে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে বারবার জিতিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনেও তার নেতৃত্বে বিপুলভাবে বিজেপি জিতেছে এবং একার ক্ষমতায় সরকার গঠনের জায়গায় পৌঁছে গেছে। এবারই ব্যতিক্রম হলো। ২২ বছরের মধ্যে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে এই প্রথমবার পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিতে পারলেন না নরেন্দ্র মোদী।
গত দুইবারের মতো এবারও দলের প্রচার ছিল মোদী-কেন্দ্রিক। তিনি দুইশটির বেশি জনসভা ও রোড শো করেছেন। একেবারে শেষ পর্যায়ে গিয়ে কলকাতায় দুই দিন কাটিয়েছেন। উত্তর কলকাতায় বিশাল রোড শো করেছেন। দেশের প্রায় সব প্রান্তে গেছেন। চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। তারপরও ব্যর্থ হয়েছেন।
জননীতি বিষয়ক গবেষক ইয়ামিনি আইয়ার বলেন, ‘মোদী শুধু প্রধান প্রচারকারী ছিলেন না, এই নির্বাচনে তিনি ছিলেন একমাত্র প্রচারকারী।’
আরও পড়ুন:
রোগীর পেটে জীবন্ত মাছি!
বারাণসীতে এবার জিতেছেন মোদি, কিন্তু ব্যবধান ও ভোটের হার কমেছে। গতবারের তুলনায় নয় দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট কম পেয়েছেন। গতবার তিনি জিতেছিলেন চার লাখ ৭৯ হাজারের বেশি ভোটে। এবার জিতেছেন এক লাখ ৫২ হাজারের বেশি ভোটে। বারাণসীতে কংগ্রেস ও ইন্ডিয়া জোটের প্রার্থী অজয় রাইয়ের ভোট বেড়েছে ২৬ শতাংশের বেশি। তিনি চার লাখ ৬০ হাজার ভোট পেয়েছেন।
এবার লোকসভার আসনসংখ্যার নিরিখে দেশের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে মোদি-ম্যাজিক কাজ করেনি। উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি পেয়েছে ৩৭টি আসন এবং কংগ্রেস ছয়টি। বিজেপি ৩৩ ও তাদের জোটসঙ্গী আরএলডি দুইটি আসন পেয়েছে।
প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা মনে করেন, ''অনগ্রসর ভোট এবার ইন্ডিয়া জোটের দলগুলিতে ফিরেছে। বিজেপি-র কিছু নেতা চারশ আসন পেলে সংবিধান বদল করার কথা বলেছিল। সেটাকেই প্রচারের হাতিয়ার করেছিল ইন্ডিয়া জোট। সেই প্রচার কাজ করেছে।’
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল জামিন পেয়ে প্রচারের শুরুতেই বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদি চারশ আসন পেলে প্রথমেই যোগী আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেবেন। তার ওই বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল।
এমনকী দীর্ঘদিন পর নিজের রাজ্য গুজরাটেও সবগুলি লোকসভা আসন জিততে পারেননি মোদি যাগত দুইবার পেরেছিলেন। এটাও তার একটা ধাক্কা।
২০১৪ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসার পর গত দশ বছরে ভারতের রাজনৈতিক পটভূমি পাল্টে দেন নরেন্দ্র মোদি। তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা দলকে ছাড়িয়ে গেছে। সংসদীয় নির্বাচনের চেহারা বদলে ক্রমশ প্রেসিডেন্সিয়াল ধাঁচের নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। এর ফলে, বিজেপি ক্ষমতায় থাকার জন্য ক্রমশ মোদী ব্র্যান্ডের উপর নির্ভর করছে। এমনকি রাজ্য বিধান সভা নির্বাচনেও স্থানীয় নেতারা পেছনের সাড়িতে চলে যাচ্ছেন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, তার এক দশকের শাসন ভারতকে গভীর ভাবে বিভক্ত করেছে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি দেশে অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণা ছড়িয়েছে এবং সংখ্যালঘুদের উপর, বিশেষ করে মুসলিমদের উপর আক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ মুসলিম।
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
এ ছাড়া মোদীর অধীনে ভারতের অর্থনীতিতে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এক দিকে স্টক মার্কেট রেকর্ড সৃষ্টি করছে এবং কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে; অন্যদিকে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ও বাড়ছে। ভারতের অল্প সংখ্যক মানুষ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে লাভবান হচ্ছেন। মোদির সমালোচকরা বলছেন, তার সরকারের অধীনে দেশের গণতন্ত্র নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের দমিয়ে রাখার জন্য সরকার ক্রমশ শক্তি ব্যবহার করছে, স্বাধীন মিডিয়ার জায়গা সীমিত করে দিচ্ছে এবং ভিন্নমত দমন করছে।
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র বলেন, ‘'নরেন্দ্র মোদী চারশ পারের ডাক দিয়েছিলেন। অনেক কম পেয়েছেন। তার দায় তিনি না নিলেও মানুষ মনে করবে, তিনি পারেননি। আরেকটা কথা এই নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে, মানুষের সমস্যা, জিনিসের দাম বাড়া, চাকরি না পাওয়ার বিকল্প হিন্দুত্ব হতে পারে না। কিছুদিনের জন্য তা হতে পারে, কিন্তু বেশিদিন এই প্রশ্নগুলো হিন্দুত্ব দিয়ে চেপে রাখা যায় না।’