আইনের প্রয়োগ না থাকায় দূষণ রোধ হচ্ছে না
দূষণ রোধে আইন থাকলেও প্রয়োগের অভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকার পরিবেশ, পানি, বায়ু এবং শব্দ দূষণে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ, কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনাল (সিপিআই) এবং ইউএসএআইডির যৌথ আয়োজনে ‘ঢাকার পরিবেশ: পানি, বায়ু এবং শব্দ দূষণ বিষয়ে নীতি, আইনী কাঠামো ও জনআকাঙ্ক্ষা’ শীর্ষক নাগরিক সংলাপে এসব কথা বলেন বক্তারা।
সংলাপে ঢাকার বায়ু এবং শব্দদূষণ এবং পানি দূষণের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার; পানি, বায়ু, ও শব্দদূষণের নীতি ও আইনি কাঠামো সম্পর্কে আলোচনা করেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ল-এর সহযোগী প্রভাষক গোলাম সারোয়ার।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের বেসরকারি উপদেষ্টা এম এস সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ-এর সমন্বয়ক শরীফ জামিলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত নাগরিক সংলাপে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। সংলাপে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিজনেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আজিজুর রহমান এবং রিভার বাংলার সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ।
সংলাপে প্রধান অতিথির আলোচনায় ড. শামসুল আলম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিরূপণে আমরা ১০০ বছরের পরিকল্পনা করেছি যা বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ পৃথিবীর ৭ম দুর্যোগপ্রবণ দেশ। আমরা ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় বলেছি, নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাপমাত্রা কমাতে হলে জলাধার সৃষ্টি করতে হবে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, ঢাকার তাপমাত্রাও বাড়ছে। সত্তরের দশক এবং গত দশকের তুলনা করলে আমরা দেখতে পাই ঢাকার তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে।’
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
তিনি বলেন, ‘আমাদের আইন, নীতি এবং কৌশলপত্র আছে, কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। আইন এবং নীতি বাস্তবায়নে আমাদেরকে কাজ করতে হবে এবং নদীকে বাঁচাতে হলে নদী রক্ষা কমিশনকে অবশ্যই বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া উচিত।’
এম এস সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের যথেষ্ট আইন রয়েছে। কিন্তু আইনের ফাঁক-ফোকরও রয়েছে একইসঙ্গে। আমাদের পরিবেশ-নদীকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।’
শরীফ জামিল বলেন, ‘আমাদের নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই তাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আনতে হবে। নদী দূষণের ফলে, বায়ু এবং শব্দ দূষণের ফলে জাতীয় অর্থনীতি এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর যে প্রভাব পড়ছে তা অবশ্যই আমাদের বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে। নৌযানগুলো অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলছে। হাজারীবাগের ট্যানারির বর্জ্য এখনো নদীতে গিয়ে পড়ছে, আবার বুড়িগঙ্গাপাড়ের অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্যও নদীতে গিয়ে পড়ছে সরাসরি। ধলেশ্বরীতে নতুন ট্যানারি শিল্পাঞ্চল দূষণ অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গার পানিতে ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়ামের মতো ক্ষতিকর ধাতু পাওয়া গেছে যা অবশ্যই শ্যামপুর ডাইং কারখানাসমূহ থেকে আসে। ঢাকার পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে সমন্বিত পরিকল্পনা স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন।’
মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনসম্পৃক্ততা নেই। জনসম্পৃক্ততার যে কথাগুলো বলা হয় তা কাগজে কলমে। ২০০৫ সাল থেকে শুরু করে ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশে যে শিল্পায়ন হয়েছে তার অধিকাংশ হয়েছে জলাধারের পাশে অথবা জলাধার ভরাট করে। এ সময় নীতি তৈরির মাধ্যমে পরিবেশ বিনষ্টের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়। শহরের রূপান্তর এবং উন্নয়নের সময় অবশ্যই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণ হয় জিরো পয়েন্ট এলাকায় যা সচিবালয়ের ১০০ মিটারের মধ্যে। ঘূর্ণিঝড় রেমাল এর পরে বায়ুদূষণের মাত্রা যতটা কমে এসেছিল সেই মাত্রায় আমরা কোভিডকালীন লকডাউনের সময়ও দূষণ কমাতে পারিনি। মেট্রোরেলের কাজের কারণেও বায়ুদূষণ বেড়েছে ঢাকায়। আর শীতকালে আমরা সাধারণ সময়ের ১০ গুণ বেশি দূষিত বায়ু সেবন করছি।’
তিনি বলেন, ‘নদীর পানিতে সাধারণত ৫ এমএল দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকার কথা কিন্তু বুড়িগঙ্গার পানিতে বর্ষাকালেও এটা পাওয়া যায় না। আর শুষ্ক মৌসুমে এটা শূন্য দশমিক ০৫ শতাংশের কম এবং কোথাও কোথাও শূন্য শতাংশে চলে যায় যার ফলে মাছ এবং জলজপ্রাণী বেঁচে থাকার কথা না।’
গোলাম সারোয়ার বলেন, ‘আমরা দূষণের যে ভয়াবহতা দেখতে পাচ্ছি এটাকে আসলে বলা হয় ইকোসাইড। সারা পৃথিবীতে যত ঘৃণিত অপরাধ রয়েছে তার মধ্যে ইকোসাইড অন্যতম। আইন তৈরি হয়েছে দূষণ বন্ধ করতে কিন্তু আদতে একে পরিবেশ ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে সেই আইনকে ব্যবহার করেই। আমাদের সৃষ্টি করা এই দূষণ এবং পরিবেশ ধ্বংসের কাজগুলো গ্লোবাল ক্লাইমেট ক্রাইসিসকে ত্বরান্বিত করছে।’
তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন হতে হবে তবে উন্নয়ন এবং পরিবেশের যে দ্বন্দ্ব তাতে অবশ্যই পরিবেশকে প্রাধান্য দিতে হবে।’
ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘পরিবেশকে বাঁচাতে হলে রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতাদের অঙ্গীকার জরুরি। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু নদী ও পরিবেশকে যে গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এসে আমরা আর দেখতে পাই না। ১৯৭০-এর নির্বাচনের ইশতেহারে আওয়ামী লীগ বলা হয়েছে, নদ-নদীগুলো বাংলাদেশের সম্পদ। একে ক্ষমাহীন অবহেলা দেখানো হয়েছে। এর থেকে মুক্তির জন্য নদী গবেষণা ইন্সিটিটিউট গঠন করা হবে।’
ড. আজিজুর রহমান বলেন, ‘অনেক আইন হয়েছে, অনেক পলিসি হয়েছে, কিন্তু বৈশ্বিক কার্বন নিঃস্বরণ বেড়েই চলেছে। কার্বণ নিঃস্বরণে যারা বেশি দায়ী দেশ তাদের পলিসিকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে।’
সংলাপে ঢাকার নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ এবং বালু নদীপাড়ের নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ সেলিম, এস এম জাহাঙ্গীর আদেল, ইশরাত জাহান লতা, উম্মে সালমা, মানিক হোসেন; বালু নদী মোর্চার নেতা ইসরাফিল হাবিব সুমন, আমজাদ হোসাইন, জান্নাতি আক্তার রুমা, তুরাগ নদী মোর্চার নেতা আমজাদ আলী লাল ও নিত্য রাজবংশী।