‘মা লো মা’ এবং জীবনের চড়াই-উতরাই
আমি যখন এই লেখাটা লিখছি, ‘মা লো মা’ গানটি তখন ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে বাংলাদেশে ১ম স্থানে এবং বৈশ্বিকভাবে ৩৮তম স্থানে আছে। সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবনযাপনের গল্প বলে এই গান। গানটিতে সমাজের সব স্তরের মানুষের জীবনের অনেকগুলো গল্প এক সুতোয় গাঁথা হয়েছে। গল্পগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়, সঙ্গীতপ্রেমীদের জীবন নিয়ে ভাবতে শেখায়। আরিফ দেওয়ান ও সাগর দেওয়ানের কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই, জীবনকে অনেক সহজ মনে করে তারা ভুল করেছিলেন। তাদের গানের সাথে এই বিশৃঙ্খল শহর যেন এক নতুন প্রাণ নিয়ে দেখা দেয়।
প্রীতম হাসানের সঙ্গীতায়োজন ও প্রযোজনায় মা লো মা দেওয়ান পরিবার থেকে প্রাপ্ত একটি প্রাচীন লোকগল্প। গানটিকে নতুন আঙ্গিকে তুলে আনা প্রসঙ্গে প্রীতম বলেন, ‘এটি অনেক পুরোনো একটি গান। কিংবদন্তী শিল্পী আরিফ দেওয়ান এই গানে অংশ নিতে রাজি হয়েছেন, এটা আমার জন্য খুবই আনন্দের ব্যাপার। এই গানে কাজ করে আমি খুবই আনন্দ পেয়েছি। নতুনত্ব আনতে আমি নিজে গানে কণ্ঠ দেইনি, শুধু কম্পোজিশনে মনোযোগ দিয়েছি। চমৎকার একজন শিল্পী সাগর দেওয়ান, তার সঙ্গে কাজের সুযোগ হয়েছে। এ ছাড়া ছিলেন র্যাপার আলী হাসান। তিনি এই প্রজন্মের বাংলাদেশী র্যাপারদের প্রতিনিধিত্ব করছেন।’
গানটির কথা থেকে বোঝা যায়, এর অর্থ অনেক গভীর এবং এতে আধ্যাত্মিক বিষয় উঠে এসেছে। তার একটি হলো বড় হয়ে ওঠা! প্রীতমের ভাষায়, ‘বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনে চাপও বাড়তে থাকে। অন্যভাবে চিন্তা করলে, মানুষের শরীর ভঙ্গুর এবং যেকোনো সময় আমরা মারা যেতে পারি- এ কথাও গানটিতে উঠে এসেছে। তবে আলী হাসানকে ধন্যবাদ, তার বুদ্ধিমত্তা এবং তার অংশের লিরিকের কারণে গানটিতে এক ধরনের ভারসাম্য এসেছে।’
‘মা লো মা’ গানের ভিজ্যুয়ালে রূপকের ছড়াছড়ির দেখা মেলে। স্টোরিটেলিংয়ের সাথে মিল রেখে ছিল ক্যামেরার চমৎকার সব কাজ। আর সেটের মাঝে নানা রকম উচ্চতার মধ্য দিয়ে চারপাশের এলোমেলো নির্মাণকাজের কথা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেইসাথে পুরান ঢাকায় দেখা যায় এমন কিছু উপাদানও রাখা হয়েছে সেখানে।
আরও পড়ুন:
ওটিটি প্ল্যাটফরম আমার জন্য বেশ লাকি
মিউজিক ভিডিওর পরিচালক আদনান আল রাজীব বলেন, অসামাঞ্জস্যপূর্ণভাবে তৈরি কিছু কাঠামো এবং আকাশ থেকে উল্টো হয়ে ঝোলা অর্ধ-দৃশ্যমান ভবন ও মেঝের সেটে একটি বিশৃঙ্খল এলাকা দেখানো হয়েছে। এর মাধ্যমে মূলত আমাদের এই বিশৃঙ্খল পৃথিবীকেই বোঝানো হয়েছে। সত্যি বলতে, উন্নত জীবনের জন্য গ্রাম ও ছোট শহরগুলো থেকে মানুষ এসব বড় শহরে আসে।
‘এই উল্টো পৃথিবী তৈরি করার পেছনে একটা চিন্তা ছিল এই যে অদ্ভুত, অপরিকল্পিত শহরে আমরা থাকি, একে তুলে ধরা। এই ভিড়ে ভরা ও অপরিকল্পিত শহরে বসবাসকারী ব্যক্তিদের অধ্যবসায় ও দৃঢ়তার বিষয়টি এই স্থাপত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। বিশৃঙ্খল এই শহরগুলোতে ক্ষমতাশালীরা কীভাবে বঞ্চিতদের নিয়ন্ত্রণ করে, তা দেখানোর জন্য সেটে আমরা অভিনেতাদের অভিনয় করা পুতুল রেখেছিলা- জানান আদনান। তাছাড়া, উন্নত জীবনের জন্য যারা এসব শহরে পাড়ি দিয়েছেন, তারা এই সেটের সঙ্গে সংযোগ অনুভব করতে পারবেন। আসলে শহরবাসীদের নিত্যদিনের এসব অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা এবং আরও অনেক কিছু উঠে এসেছে এই বিশৃঙ্খল সেটের মাধ্যমে।
শহরের আরেক প্রান্তে দেখা যায়, একদল নারী নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ পেটাচ্ছেন। শার্ট ও লুঙ্গি পরিহিত তাদের দলনেতা নেচে নেচে তাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। সুর আর ভোকালাইজেশনের সাথে ছাদ পেটানোর এই প্রাচীন ঐতিহ্য গানে একটি চমৎকার সংযোজন। কোলাহলপূর্ণ এই শহরকে এটি রঙিন করে তুলেছে। এটি গানে সংযোজন বিষয়ে প্রীতম বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় আমি প্রথম ছাদ পেটানো দলের গান গেয়ে ছাদ পেটানোর ভিডিও দেখি। আমি ভিডিওটি থেকে গানটি সংগ্রহ করি। “মা লো মা” গানে এই দলকে বেহুলা-লখিন্দরকে নিয়ে করা একটি গানের দীর্ঘ সংস্করণ গাইতে দেখা যায়। সাধারণত কাজ করার সময় তারা এই গানটি গেয়ে থাকেন।’
নৌকার রূপকটি গানে বারবার এসেছে। এই গানের নৌকা ভাঙা ও গর্তে পূর্ণ। আরিফ দেওয়ান ও সাগর দেওয়ান একটি নৌকার চিত্র তুলে ধরেন, যা লক্ষ্যহীনভাবে, নিঃসঙ্গ অবস্থায় নদীতে ভাসছে। এখানে নৌকাকে জীবনের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের জীবনের স্বপ্ন পূরণের চ্যালেঞ্জ যেন অনেক বড় এক বোঝায় পরিণত হয়। এক কথায় বলতে গেলে, এই পৃথিবীতে বেড়ে ওঠার লড়াই মানুষের জীবনের প্রায় সবটাই শুষে নেয়।
আরও পড়ুন:
নানাকে নিয়ে পরীর আবেগঘন পোস্ট
সুর ও কথার মাধ্যমে নিজেদের দুর্দশার কথা চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন দুই দেওয়ান ভাই। ঐতিহ্যবাহী লোকগীতির মধ্য দিয়ে বর্তমান পৃথিবীর সংকট তুলে ধরেছেন তারা।
কিন্তু জীবন কি শুধুই দুঃখ-কষ্টে ভরা, দেওয়ান ভাইরা যেমন বলছেন? এমনও তো হতে পারে যে, শুধু যোগ্য হলেই চলবে না, টিকে থাকতে হলে স্মার্টনেসেরও প্রয়োজন আছে। আলী হাসান টেম্পো থেকে লাফ দিয়ে নামার পরেই গান অন্যদিকে মোড় নেয়। সুরে সুরে বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সমাধান তুলে ধরেন তিনি। যেন তিনি আবির্ভূত হন অনেকটা এক সুপারহিরোর মতো।
‘ব্যবসার পরিস্থিতি’ ও ‘বাজার গরম’ এই হিপ-হপ গানগুলো দিয়ে সবার কাছে পরিচিত শিল্পী ও র্যাপার আলী হাসান। আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মতো বিষয়ে চতুরতার সঙ্গে নানা ধরনের মন্তব্য ও উত্তর সাজিয়ে র্যাপ করেন তিনি। ‘মা লো মা’ গানে তার র্যাপের মধ্য দিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও ইতিবাচকতার প্রকাশ ঘটে।
আলী হাসান আসার পর গানের পুরো চরিত্রটাই বদলে যায়, কারণ দেওয়ান ভাইদের বলা সমস্যাগুলোর উত্তর ও সমাধান তার কাছে আছে। আদনান বলেন, ‘ভিজ্যুয়ালি আমরা ব্যাপারটাকে প্রাণবন্ত করে তুলতে চেয়েছি। তাই হাজির বিরিয়ানি এবং “বুজি ফিল্ম”র মতো পুরান ঢাকার কিছু উপাদান যোগ করেছি ওই অংশে।’
আরও পড়ুন:
‘এভাবে বিয়ে করা নাকি অর্থহীন’
আলী হাসান বলেন, ‘নৌকা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই, তবে জীবনে টিকে থাকতে সাঁতার জানা প্রয়োজন। বলা তো যায় না, জীবনের নৌকা কখন নদীতে ডুবে যায়’। তার কথা দিয়ে সহজেই শ্রোতাদের মন জয় করে নেন হাসান।
ছাদ পেটানো দল সুন্দরভাবে ছাদ পিটিয়ে যাচ্ছেন, হিপ-হপের মাধ্যমে জীবন ও টিকে থাকার বাস্তবতার উত্তর দেওয়া হচ্ছে। এতসবের মধ্যে আমাদের পৃথিবীকে তুলে ধরার জন্য যে উল্টো পৃথিবী তৈরি হয়েছে, তাকে আর খুব বেশি খারাপ মনে হয় না। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য হয়তো এটিই দরকার- ক্লান্তিকর দিনের শেষে এমন একটি জায়গা যেখানে সবকিছু মিলে ভালো কিছুই হয়।
লেখক: সংগীতশিল্পী ও সাংবাদিক