ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের উদাহরণ সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের যে লুটপাট ও নৈরাজ্য চলছে তারই উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা। সাংবাদিক সরকারের সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকেন। আসন্ন বাজেটকে সামনে রেখে এখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার আহ্বানও জানান তারা। আজ বুধবার ইআরএফ কার্যালয়ে ‘সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা আরোপ বিষয়ে নেতৃবৃন্দকে অবহিতকরণ’ শীর্ষক সভায় এ কথা বলেন সিনিয়র সাংবাদিক নেতারা। ইআরএফ সভাপতি রেফোয়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
অনুষ্ঠানের ভোরের কাগজ সম্পাদক এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘এখন ব্যাংক খাত থেকে একজন পি কে হালদার কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে নিয়ে যাবেন অথচ কিছু বলা যাবে না এটাতো হতে পারে না। একজন ব্যক্তি সাত থেকে আটটি ব্যাংকের মালিক কিভাবে হন। সরকারের উন্নয়নের সহায়ক ভূমিকা পালন করে সাংবাদিকরা। সামনে বাজেট আসছে। এমন এক সময়ে কেনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। হলমার্কসহ সবগুলো আর্থিক অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ করে সরকারকে সহযোগিতা করেছে গণমাধ্যম।’
তিনি আরও বলেন, ‘তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত আমাদের বলেছেন এ বিষয়টি (প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা) নিয়ে কাজ করছেন। তবে আমাদেরও এ বিষয়টি শক্ত হাতে করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে যে নৈরাজ্য চলছে তারই একটি অংশ হচ্ছে সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ করতে না দেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে ৮০০ কোটি টাকা চুরি হয়ে গেছে, এতে কি চোরকে বাংলাদেশ ব্যাংকে আসতে হয়েছে। এই ৭-৮টা ব্যাংকের মালিক একটা গ্রুপ। তারা সম্প্রতি আরও একটি ব্যাংক নিয়ে নিছে। তাদের বিরুদ্ধে কথা কথাও কঠিন, কারণ তাদের পত্রিকা, টেলিভিশন ও অনলাইন আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ে আর বসে থাকার সময় নেই। ইআরএফ একটি সম্মানিত সংগঠন। এই আন্দোলনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে আপনাদের সংঙ্গে আছি। আন্দোলন আরও বেগবান করুন। সাংবাদিকদের রিপোর্টগুলো সরকারকে সাহায্য করে। তাই এই আন্দোলন আরও জোরেসোরে চালান। বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশের দাবি আদায় করেই ছাড়ব।’
বিএফউজের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী বলেন, ‘ব্যাংক রিপোর্টাররা আজ সমস্যায় পড়েছেন, এটা আরও বাড়বে। ধীরে ধীরে সাংবাদিকরা আরও সমস্যার সম্মুখীন হবেন। দলমতের বাইরে এসে পেশাদারিত্বের জায়গায় আমাদের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। সকল সংগঠন সংঘবদ্ধ হয়ে আগাতে হবে। অতীতেও আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে আমাদের অধিকার আদায় করেছি। শেয়ারবাজার, ডলার বাজারে যেসব অপকর্ম করা হয় এগুলো তো কর্মকর্তারাই ঘটান, সাংবাদিকরা শুধু তা লিখে তুলে ধরেন।’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে এমন একজন গভর্নরকে বসানো হয়েছে, তিনি তার যোগ্যই নন। তার যেই দুর্বলতা আছে সেটি ঢাকার জন্যই তিনি সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বর্তমান গভর্নরের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো সূচকেই সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। পূর্ব কোনো ঘোষণা ছাড়াই ডলারের দাম একলাফে সাত টাকা বাড়িয়ে দিলেন কীসের ভিত্তিতে? কিছু পীর-আওলিয়া-দরবেশদের সুবিধা দিতে গিয়েই সাংবাদিকদের এমন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তারা দরজায় খিল দিয়েছে কিন্তু দরজা বন্ধ করতে পারেনি। প্রয়োজনে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের গেটে অবস্থান নিব। গভর্নরকে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ করতে দিব না। আমাদের অধিকার আদায় করেই আমরা ছাড়ব।’
বিএফইউজের মহাসচিব আব্দুল কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ‘ব্যাংকিংখাতে এখন আড়তদার তৈরি হয়েছে, একজনই অনেক ব্যাংকের মালিক। এছাড়া রিজার্ভ চুরি, ভল্টের সোনা চুরি এসবের খবর যেন জনগণের সামনে না আসে, তাই চোরদের পাহারা দেওয়ার জন্যই এমন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ন্ত্রণ সংস্থায় সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞায় আমরা বিষ্তিত হয়েছি, এর মাধ্যমে কণ্ঠরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘অতীতেও পেরেছি এবারও পারব। যখন সকল মত-পথের সাংবাদিক একসঙ্গে হয়েছি, সেহেতু পারবই। যে তথ্য নিয়ে জনগণের জন্য সংবাদ করা হয় তা কখনো চুরি হতে পারে না। এখন শুধুমাত্র আর্থিক খাতেই কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খাওয়ার (অনিয়ম) যে জায়গা, সেটিই সাংবাদিকরা বন্ধ করে দিচ্ছে বলেই আজ এই অবস্থা। গণমাধ্যম একটা চরম সংকটে আছে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে একসঙ্গে লড়াই করতে হবে।’
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সৈয়দ শুকুর আলী শুভ বলেন, ‘সাংবাদিক যদি বাংলাদেশে থাকে, তথ্য তাকে দিতেই হবে। যখনি তথ্য দিবে না তখনি লুকোচুরির বিষয় থাকবে বলেই আমরা ধরে নেব। গভর্নর তো কিছুদিনের জন্য। আমাদের অধিকার আমাদেরই আদায় করে নিতে হবে। যুগে যুগে সাংবাদিকদের অধিকার আদায় করে নিতে হয়। সাংবাদিকরা কোনো ব্যক্তির জন্য কাজ করে না, তারা পুরো দেশের জন্য কাজ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অবশ্যই সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গেট বন্ধ করে অবস্থান নেব।’
ইআরএফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশের মুক্তিযোদ্ধারা এ দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। এখন সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশাধিকার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এ স্বাধীনতাকে কূলষিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামী ৭ কার্য দিবসের মধ্যে গভর্নর সাহেবকে পদক্ষেপ নিতে হবে। সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে অতিদ্রুত। মুখপাত্রের কাছে কোনো তথ্য চাওয়া হলে তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাংবাদিকদের প্রদান করতে হবে।’
ইআরএফের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ও ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগে ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে আমাদের যেসব তথ্য দেওয়া এখন আর সেগুলো হয় না। অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রকাশ করলে তাদের সমস্যা হয় এ কারনেই প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।’
ইউএনবির সম্পাদক ফরিদ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করছে। এই যে প্রতিনিয়ত পত্রিকায় তাদের ব্যাপারে রিপোর্টগুলো হচ্ছে এসব করে তাদের নিজেদের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এই কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তারা কি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতেই এমন করছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।’
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সাংবাদিকদের নিষেধাজ্ঞা শুধু ব্যাংক রিপোর্টার বা অর্থনীতির রিপোর্টারদের অসম্মান করা হচ্ছেই না, এটি পুরো গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরা হচ্ছে। আমাদের সবার উচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অবস্থান নেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তার দুর্নীতির ফাইল জমা হয়ে আছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করলে তারা নিজেরাই আমাদের কাছে চলে আসবে।’
ইআরএফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, ‘এ ইস্যুটি শুধু ব্যাংক রিপোর্টারদের জন্য না, এটি সবার জন্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এটির যদি সফলতা পেয়ে যায় তাহলে সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া শুরু করবে। আর এই হুমকি আমাদের আগামীর ভবিষ্যতের জন্য ভয়ানক। টাকা ছাপিয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ানো হচ্ছে। সরকার যদি মনে করে যে বাংলাদেশ ব্যাংকে নিষেধাজ্ঞা থাকলে সরকার অনেক কিছু আড়াল করে ভালো থাকবেন তাহলে এটা ভুল। বরং সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশ করে দিলে অর্থনীতি আরও ভালো থাকবে। দুর্নীতিগুলো সামনে আসবে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে।’
ইআরএফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নাগরিক প্রতিষ্ঠান, আর নাগরিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য জনগণের পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাই দ্রুতই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা উচিত। সরকারের ভালোর জন্যই এই সুযোগ তৈরি করা উচিৎ।’
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা বলেন, ‘আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, গভর্নরের সঙ্গে কথা বলেছি, উনি বলেছে আসা যাওয়া করতে থাকো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দেড় মাস পার হলেও এখনো আমাদের সহকর্মী সাংবাদিক ভাইয়েরা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ করতে পারছেন না। আগে সাংবাদিকরা যেভাবে সহজে যেকোনো অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন তা এখন পারছেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘গভর্নর আমাদের দেশ প্রেমিক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে আমাদের চেয়ে বেশি দেশ প্রেমিক লোক আর দেখছি না, আমরা যা করি দেশের জন্যই করে থাকি। সহকর্মীরা বলছেন যে তাদের ফোন ট্র্যাকিং করা হচ্ছে। যা খুবই ভয়ানক ব্যাপার। তাই এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের বৃহত্তর কর্মসূচিতে যেতে হবে।’
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী, অপর অংশের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক খুরশিদ আলম, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি সৈয়দ শুকুর আলী শুভ, সাধারণ সম্পাদক মহি উদ্দিন আহমেদ, ইআরএফের সাবেক সভাপতি ও ইংরেজি দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, ইউএনবির সম্পাদক ফরিদ হোসেন, সিনিয়র সাংবাদিক সোহেল মঞ্জুর, ইআরএফের সাবেক সভাপতি মনোয়ার হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, জিয়াউর রহমান ও এস এম রাশিদুল ইসলামসহ আরও অনেকে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?