বৈশাখ বাঙালির মহামিলনতীর্থ
বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সাক্ষ্য দেয়, উৎসবপ্রবণ জাতির মধ্যে বাঙালি অগ্রগণ্য। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ সেই সাক্ষ্যের উৎস। ক্ষুদ্র হোক বা বড় হোক, যে কোনো আয়োজন বা উপলক্ষকে উৎসবে রূপদান করতে বাঙালির জুড়ি নেই। উৎসব-অন্তপ্রাণ বাঙালির আর্থিক সামর্থ্যরে চেয়ে মানসিক সামর্থ্য অধিক ও অপরাজেয়। তাই সে নিমিষেই উৎসব আয়োজন করে ফেলতে পারে অন্তহীন উদ্যমে। গ্রামে গ্রামে বটতলায় বা হাটবাজারের মোড়ে কিংবা ফসল ঘরে তোলার পর নাড়াঅলা ক্ষেতে, বাড়ির বড় আঙিনায় রাত জেগে হ্যাজাক লাইটের আলোয় বাঙালি অতীতে মেতে উঠত কবিগানের জাদুতে। আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষ এসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত কবিয়ালদের চাপান-উতোর। খুশি হয়ে পরিয়ে দিত টাকার পুরস্কারের মালা। এভাবেই সামান্য বিষয়ও হয়ে উঠত এলাহী কারবারের মতো। শ্রমজীবী মানুষের আত্মার বিনোদনই হয়ে উঠত উৎসব। এ উৎসবের তালিকায় যেমন ছিল যাত্রাপালার আয়োজন, তেমনি ছিল হলকর্ষণ, বসুমতীর লোট কিংবা ধর্মীয় মেলা। আজও ধর্মীয় মেলার উৎসব পল্লী বাংলার সোঁদা মাটির বুকে মানুষকে একত্রিত করে মিলনমেলার বাণী নিয়ে। ওরস কিংবা রথের মেলা, কীর্তন কিংবা রাস উৎসবের মেলা উৎসব-উন্মুখ বাঙালির মনে ধর্মের চেয়ে আনন্দের খোরাক নিয়ে আসে অধিক। সন্তান জন্মের পর দোলনায় চড়ানোকে কেন্দ্র করে ছোটখাটো উৎসব হয়ে যায় সামর্থ্যবান বাঙালির ঘরে ঘরে। নবজাতকের দোলনার নিচে মুড়ি-বাতাসা ছিটিয়ে দেওয়া ও তা কুড়িয়ে খাওয়ায় কেবল অনুষ্ঠানের আচার পালিত হয় না, উৎসবের সুরও বেজে ওঠে। বিয়ে এ যুগে আর্থিক সামর্থ্যরে প্রদর্শনী হয়ে গেলেও আগে পল্লী বাংলায় বিয়ে ছিল সত্যিকারের সামাজিক উৎসব। কোনো ঘরে বিয়ে নামা মানেই গ্রামের মানুষের সেই অনুষ্ঠান আয়োজনে কোমর বেঁধে লাগা। সপ্তাহকাল আগে থেকে দূর-দূরান্তরের গাঁয়ের নাইয়রি এসে জমিয়ে তুলত বিয়ের আনন্দযজ্ঞকে। দুদিন আগে থেকেই মেয়েদের কণ্ঠে বিয়ের গীত দারুণ জনপ্রিয় ছিল গ্রামীণ বাংলায়। উৎসবের সেই আয়োজন এবং সেই উদযাপন আজ বিরল। করপোরেট জীবনের চাকচিক্য আর বিপুল অর্থের ছড়াছড়ি উৎসবকে প্রাণের আঙিনা থেকে নিয়ে গেছে শোভা প্রদর্শনের বাড়াবাড়িতে। উৎসব আজকাল জাঁকজমকে রাজকীয় থাকলেও প্রাণ থাকে না, শেকড়ের গন্ধ থাকে না।
উৎসবে মাতোয়ারা বাঙালির সর্বজনীন উৎসবের মধ্যে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। এ উৎসব বনেদি মানুষের নয়, মূলত এ উৎসব মাটির মানুষের। গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে এ উৎসবের আমেজ ও বর্ণিলতা ছড়িয়ে পড়ে। আবহমানকাল থেকেই পহেলা বৈশাখ বাঙালিকে রঙেরসে রাঙিয়ে দিয়ে যায়। চৈত্র মাসের শেষের আগের দিন সন্ধ্যায় উঠোনে ‘জাগ’ নামের স্তূপীকৃত জঞ্জাল ও কাটা ঝোপে আগ বা আগুন দিয়ে পোড়ানো হতেই শুরু হয়ে যায় বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের আনন্দ ও আয়োজন। তারও আগে বছরের শেষ দফায় ধুল-ঝুল ঝেড়ে বাড়িঘর পরিষ্কারের অভিযান চলে। চৈত্রের শেষদিনে গ্রামের ঘরে ঘরে মুড়ি-মুড়কি-খৈ-লাবণের উৎসব শুরু হয়। বানরের গিলা গায়ে মেখে স্নান অতীতের চৈত্রসংক্রান্তিকে এখনো মনে করিয়ে দেয়। বিভিন্ন পদের উপকরণ মিলিয়ে তিতা খাওয়া বা পাঁচনের (পাজন) রান্না চৈত্রকে বিরস বদনে বিদায় দেওয়ার এক নান্দনিক চর্চা। চৈত্রের শেষ সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই একটি বছরের ইতি হয়, ইতি ঘটে জীর্ণ পুরাতনের। নতুন আশা নিয়ে নতুন আলোয় নববর্ষের প্রথম ভোরে ঊষার অভিষেক হয়। সে অরুণে থাকে নতুন সম্ভাবনার দীপালি। বৈশাখের খরতাপে দগ্ধ হয়ে যেন নতুন জীবনের পুণ্য জ্ঞান হয়। আবার নতুন তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের পাঁচালির জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় জীবনের রঙ্গমঞ্চ। নতুন দিনের ভোর হয় স্নানে পবিত্র হয়ে, নতুন পোশাকের নতুন সম্ভাবনায়। তার পর থাকে ঘোরাঘুরি আর দিনশেষে নিজের বাড়িতে বিশেষ আহার।
পহেলা বৈশাখের যাত্রাপথ কিন্তু কুসুমাস্তীর্ণ নয়। শুরু থেকেই একে হিন্দুয়ানি উৎসব বলে অবজ্ঞা করা হতো। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। তবু এর মাঝেই আমাদের শেকড়ের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জানা-অজানা ভুল ব্যাখ্যায় পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলেও কোনো অবস্থাতেই এর মান ও চেতনার ব্যত্যয় ঘটবে না। পহেলা বৈশাখ মিশে আছে আমাদের শোণিতে, স্বেদবিন্দুতে এবং জীবনযাপনে। মানুষ অজ্ঞতাহেতু ধর্মকে সংস্কৃতির এবং বিজ্ঞানকে ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসেবে ধরে নিয়েছে। এর পরিণামে মারামারি-হানাহানিতে ব্যস্ত হয়ে মানবিকতাবোধ বিলীন হয়ে গেছে একদা সম্প্রীতির তীর্থভূমিখ্যাত বাংলাদেশে।
আরও পড়ুন:
নববর্ষে আন্তর্জাতিক জয়যাত্রা
সাতাশটা নক্ষত্রের প্রভাবকে মাথায় রেখে তাদের বারোটির নামে নামকরণ করা হয় বাংলা বারো মাসের। প্রথমটির নাম ছিল মার্গশীর্ষ বা মৃগশিরা। তারই নামে নাম হলো অগ্রহায়ণের। এটাই ছিল আগেকার বাংলা বর্ষের প্রথম মাস। এরূপ নামকরণে আর্যভট্ট, বরাহমিহির প্রমুখ জ্যোতির্বিজ্ঞানীর ভূমিকা ছিল যা জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রাচীন গ্রন্থ সূর্যসিদ্ধান্তে লিপিবদ্ধ আছে। গ্রন্থটি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে রচিত হয়। কিন্তু তার অনেক বছর পরে সম্রাট আকবরের আমলে ষোলশ খ্রিস্টাব্দে প্রজাদের খাজনা আদায়ে অসুবিধা হলে তিনি তার সভাসদ আবুল ফজল ও টোডর মলের বুদ্ধিতে আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে দায়িত্ব দেন, যাতে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে খাজনা আদায়ের মতো করে সংস্কার করা হয়। সেই মোতাবেক আমরা বৈশাখকে পাই নববর্ষের প্রথম মাস হিসেবে। অগ্রহায়ণকে সরিয়ে বৈশাখে এসে নববর্ষ নতুন ঠিকানা পায়। বাংলা বর্ষপঞ্জি সম্রাট আকবরের হাতে সৃজিত নয়, তিনি এর সংস্কার করেন মাত্র।
যদিও পহেলা বৈশাখ নতুন কোনো সূর্যের দিন নয়, তবুও নববর্ষ এক আবেগের নাম, চেতনার নাম। নববর্ষ কেবল পান্তা-ভর্তা খাওয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়, নববর্ষ তার চেয়েও বেশি কিছু। নববর্ষ আমাদের শেকড়, নববর্ষ আমাদের ঐতিহ্য। নববর্ষ কোনো ধর্মীয় উৎসব নয়, নয় কোনো সাম্প্রদায়িক চর্চা। নববর্ষ মানেই শাশ্বত বাঙালিয়ানার মহামিলন। বিশ্বমানব হওয়ার তত্ত্ব আমাদের নববর্ষই দিয়ে যায় উৎসবের সর্বজনীনতায়। আজকাল বাঙালির নববর্ষের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এ শোভাযাত্রার মাধ্যমেই শেকড়ের সংস্কৃতিকে আধুনিক মানুষের মনের সরোবরে পৌঁছে দেওয়া যায়। শোভাযাত্রার বর্ণিলতায় ধনী-গরিব সবাই সমান হয়ে যায়। বাংলার প্রকৃতি যেন শোভাযাত্রায় শামিল হয়। বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে-গীতিতে দোলা দিয়ে নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা এগিয়ে যায় আমাদের চিরায়ত সৌন্দর্যকে ধারণ করে। নববর্ষের উদযাপনের সঙ্গে ধর্মের যেমন বিরোধ নেই তেমনি যারা সংস্কৃতির চর্চায় ধর্মীয় বিধিনিষেধকে টেনে আনেন তারাও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা হতে তা করে থাকেন।
আরও পড়ুন:
বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশ ও অন্যান্য
বৈশাখ নিয়ে বিদুষী খনা অনেক বচন মুখে মুখে রচনা করেগেছেন। এর মধ্যে একটি হলো, ‘পৌষের কুয়া বৈশাখের ফল / যতদিন কুয়া ততদিন জল।’ অর্থাৎ বৈশাখের ফল অত্যন্ত সরস ও মিঠা হয়। কৃষিজীবী গ্রামবাংলায় খনা কৃষককে চাষের নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, ‘শুনরে বেটা চাষার পো / বৈশাখ জ্যৈষ্ঠে হলুদ রো।’ আবার কোন্ শাক কখন খেতে হবে এ বিষয়ে খনার বচনে প্রসঙ্গক্রমে বৈশাখের কথা এসেছে। চৈত্র মাসে গিমা তিতা এবং বৈশাখে নালিতা পাটশাক মিষ্টি হয়, এ কথা জানিয়ে খনা আমাদের কাছে বৈশাখের গুরুত্বকে প্রগাঢ়ভাবে তুলে ধরেন। এমনকি খনার মতে যে বছর বৈশাখে শীত পড়বে সে বছর কদাচিৎ বর্ষায় বৃষ্টি হবে। অর্থাৎ বৈশাখ সম্পর্কে বলতে গিয়ে খনা আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনপর ভয়াবহ পরিণামকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
আমবাঙালির চেতনায় মুখর ধারায় নববর্ষকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পহেলা বৈশাখ আমাদের ঐক্যের বৈশাখ, পহেলা বৈশাখ আমাদের বাঙালি চেতনাকে নবায়নের বৈশাখ। বৈশাখ আমাদের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা মুক্তির শক্তি দিক, সাহস দিক। বৈশাখ আমাদের সহাবস্থান ও সম্প্রীতির দীক্ষা দিক। এবারের বৈশাখ হোক প্রাণে প্রাণে মিল করে দেওয়ার বৈশাখ। এবারের বৈশাখ হোক মুক্তবুদ্ধির বিজয়ের বৈশাখ। বৈশাখ হোক স্মার্ট বাংলাদেশের, বৈশাখ হোক শেকড়লগ্ন বিশুদ্ধ বাঙালির, বৈশাখ হোক সত্যিকারের মহামিলনতীর্থ।
আরও পড়ুন:
বর্ষবরণ উৎসব