বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশ ও অন্যান্য
পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরণ বাঙালির প্রাণের উৎসব। এক নতুন শুরুর স্বপ্ন নিয়ে বাঙালি এ উৎসব উদযাপন করে। বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনে লাল-সাদা পোশাক পরে বৈশাখী মেলায় যাওয়া, বাঙালির চিরায়ত খাবার পান্তা ভাতের সঙ্গে নানারকম ভর্তা, ইলিশ মাছ ভাজা, আলপনা আঁকা, জারিসারি গানের সুর, পুতুল নাচ- এসবই বর্ষবরণ উৎসবের অংশ। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা যেন ফিরে যাই হারানো ঐতিহ্যের কাছে। নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিই আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতির সঙ্গে।
পোশাকে বিবর্তন : যে কোনো সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ তাদের নিজস্ব পোশাক। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হতে থাকে পোশাকের ডিজাইন বা ফ্যাশন ট্রেন্ড। বর্ষবরণের সঙ্গে হালখাতার সম্পর্কটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। জানা যায়, সম্রাট আকবরের সময় বাকি খাজনা আদায়ে কৃষক-শ্রমিকদের জন্য যে হালখাতার আয়োজন করা হয়েছিল, কালক্রমে সেটাই নববর্ষ উৎসবে রূপ নেয়। মনে করা হয়, লাল সালুতে মোড়ানো সাদা খাতার কনসেপ্ট থেকেই এসেছে বর্ষবরণের পোশাক ডিজাইনের আইডিয়া। সেই থেকে পহেলা বৈশাখে বাঙালি পুরুষ সাদা পাঞ্জাবি আর নারীরা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি বা গরদ শাড়ি পরতে শুরু করে। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন সেই লাল-সাদা পোশাকে যোগ হয়েছে ভিন্নমাত্রা। দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে এখন আন্তর্জাতিক ধারার সংমিশ্রণে দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো তৈরি করে বর্ষবরণের বাহারি রঙ ও নকশার পোশাক। এখন আর শুধু সাদা পাঞ্জাবি, লাল পেড়ে সাদা শাড়ি নয়, সব বয়সী নারী-পুরুষ, শিশুদের জন্য তৈরি করা হয় বাহারি রঙের পোশাক। পোশাকের নকশায় মোটিফে উঠে আসে বাঙালি সংস্কৃতির অনুষঙ্গ ফুল, পাখি, লতা-পাতা, পাখা, ঘুড়ি, কুলা, আলপনা, বাঁশি, ঢাক- ঢোল ইত্যাদি। রঙের ক্ষেত্রে লাল-সাদার পাশাপাশি প্রকৃতির সব রঙই ব্যবহার করা হয়। আর এসব পোশাক তৈরি করা হয় দেশীয় কাপড় দিয়ে, যে কাপড়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের তাঁতিদের অক্লান্ত পরিশ্রম। আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য। এসব পোশাক পরে আপামর মানুষ যোগ দেয় বর্ষবরণ উৎসবে।
আরও পড়ুন:
বৈশাখ বাঙালির মহামিলনতীর্থ
পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ : নতুন বছরে অতিথি আপ্যায়নে মিষ্টিমুখ করানোর চল তো সেই হালখাতা থেকেই শুরু। এ ছাড়া জলখাবার হিসেবে দই, চিঁড়া, মুড়ি, মুড়কি, বাতাসা, কদমা, নাড়ু, মোয়া, নানারকম নকশি পিঠা, আমাদের ঐতিহ্যের খাবার। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। গৃহস্থ বাড়িতে রাতে বেঁচে যাওয়া ভাত পানি দিয়ে রাখা হতো। সকালে সেই পান্তা পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ দিয়ে খেয়ে কৃষক মাঠে কাজে যায়, গ্রামবাংলার চিরায়ত এই খাদ্যাভ্যাসটাই প্রতীকীরূপে পালন করা হয় পহেলা বৈশাখে পান্তা ভাতে নানারকম ভর্তা, ইলিশ মাছ ভাজার আয়োজন করে। তবে সময়ের পরিক্রমায় বাংলা বর্ষবরণের খাবারও বহুমাত্রিকতা পেয়েছে। পান্তা-ইলিশের পাশাপাশি খিচুড়ি, মাংস, মাছের কালিয়া- কোপ্তা, চিংড়ির মালাইকারিসহ আরও অনেক আয়োজন করা হয়ে থাকে। আর এসব খাবার এখন আর শুধু বাসাবাড়িতেই তৈরি হয় না। হোটেল রেস্তোরাঁয়ও থাকে বর্ষবরণের নানা আয়োজন। এসব আয়োজনেও থাকে বাঙালিয়ানা। পাটি পেতে, মাটির বাসনে পরিবেশন করা হয় খাবার। অনেকে সেই সময়ের মতো কলাপাতায়ও খাবার পরিবেশন করেন। উৎসব উদযাপনে বাংলা সংস্কৃতির ধারক-বাহক এসব খাবার মানুষ পরিবার-পরিজন, বন্ধুদের নিয়ে উপভোগ করে।
আরও পড়ুন:
নববর্ষে আন্তর্জাতিক জয়যাত্রা
বৈশাখী মেলা, ছায়ানটের গান ও আনন্দ শোভাযাত্রা : পহেলা বৈশাখের এক গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন বৈশাখী মেলা। সম্রাট আকবরের বাংলা সনের উদ্ভাবনের পর পরই বৈশাখ উদযাপনের আরেক অনুষঙ্গ হিসেবে উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বৈশাখী মেলার। গ্রামীণ কৃষক ও সাধারণ মানুষ এ মেলার আয়োজন করত। জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর মানুষের অংশগ্রহণে এ মেলা এক অসাম্প্রদায়িক রূপ নেয়। আধুনিককালে এ মেলা গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গেছে নাগরিক জীবনেও। পহেলা বৈশাখে শহরের বিভিন্ন জায়গায় বসে বৈশাখী মেলা। মেলায় হস্ত ও কুটির শিল্পের নানা পণ্য যেমনÑ তাঁতের শাড়ি, গামছা, মাটির পুতুল, ঘুড়ি, পাখা, মাটির বাসন, কাচের চুড়ি, খেলনাসহ গৃহস্থালি নানা জিনিস, ঐতিহ্যবাহী খাবার সবকিছুই স্থান পায়। বিনোদনের জন্য থাকে পুতুল নাচ, নাগরদোলা, বায়োস্কোপ, লাঠিখেলা, মোরগযুদ্ধ, জারি-সারি গান ইত্যাদি। তবে বর্ষবরণ উৎসবের এখন অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়নের প্রভাতি অনুষ্ঠান। নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়ের নরম ভোরে রমনার বটমূলে সুরে ও বাণীতে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত কণ্ঠে বাঙালির কবিগুরুর গানে, কবিতায়, বাঁশির সুরে এক অন্যরকম আবহের সৃষ্টি হয়। সে আয়োজনে বাহারি পোশাক পরা নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোররা যোগ দেয়। প্রতিবছর ছায়ানট ভিন্ন ভিন্ন থিমে অনুষ্ঠান সাজিয়ে থাকে। দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, প্রকৃতি বন্দনা, আত্মশুদ্ধি, জাগরণের বাণী ও সুরে মুখর হয়ে ওঠে রমনা প্রাঙ্গণ। প্রসঙ্গত পাকিস্তান আমলে বৈরী পরিবেশে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে ছায়ানটের যাত্রা শুরু হয়। এর পর অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটানোর জন্য ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে শুরু হয় বাংলা বছরকে বরণ করে নেওয়ার আয়োজন। সেই থেকে নানা সময়ে বাধা-বিপত্তিকে জয় করে ছায়ানট তাদের এই কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রাণে প্রাণে, যা আজ মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ^ময়। বর্ষবরণের এই উৎসব এখন আর শুধু আনন্দ উৎসবই নয়, এ উৎসব আপামর বাঙালিকে আবদ্ধ করে সম্প্রীতির বন্ধনে। ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষে চারুকলার বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রাও বাঙালি ঐতিহ্যেরই অংশ হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন:
বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশ ও অন্যান্য