নীল প্যাডে কাঠ পেন্সিলে হত্যাযজ্ঞের নীলনকশা

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
২৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
নীল প্যাডে কাঠ পেন্সিলে হত্যাযজ্ঞের নীলনকশা

আজ ভয়াল ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিন মধ্যরাতে বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে ভয়াল বিভীষিকা। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট। পুলিশ, ইপিআর, নারী-শিশু আর খেটে খাওয়া বাঙালির রক্তে ভেসে যায় রাজপথ, অলিগলি। হানাদার বাহিনী নীল প্যাডে পরিকল্পনা এঁকেছিল কাঠ পেন্সিলের মাধ্যমে। যাতে কাঠ পেন্সিলের লেখা দ্রুত মুছে গিয়ে খুন আর রক্তের ইতিহাসও মুছে যায়। তবে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।

অপারেশন সার্চলাইটের নির্দেশনামা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়।

২৫ মার্চ অভিযান চালানোর এক সপ্তাহ আগে পরিকল্পনা করেছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা। সাধারণ এক কাঠ পেন্সিলে এই পরিকল্পনা লেখা হয়। ১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ শিরোনামের একটি বই লিখেছেন। সেই বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘জেনারেল রাও ফরমান আলী হালকা নীল কাগজের অফিশিয়াল প্যাডের ওপর একটি সাধারণ কাঠ পেন্সিল দিয়ে পরিকল্পনার খসড়া লিখেছিলেন।’

গবেষকরা মনে করেন, কাঠ পেন্সিলের লেখা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। কাঠ পেন্সিল দিয়ে লেখা হয়েছিল, যাতে প্রমাণ বা দলিল হিসেবে তা না থাকে।

গণহত্যার পরিকল্পনাকারী মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ২০১২ সালে ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সেই আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়।

স্মৃতিচারণ করে রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকালে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি।’ পরদিন সকালে খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট।

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, সেই রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় তিন হাজার বাঙালিকে। জ্বালাতে শুরু হয় ঘরবাড়ি, দোকানপাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।

বাঙালি গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দুপুরের পর থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। সকাল থেকে সেনা কর্মকর্তারা হেলিকপ্টারযোগে দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকালের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসে। ঢাকার ইপিআর সদর দপ্তরে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাংক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাংক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময়।

২৫ মার্চের টার্গেটে ছিল রাজারবাগ, পিলখানা, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের হলসহ রাজধানীর অলিগলি। ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর মেশিনগান ও কামান-ট্যাংক নিয়ে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। সেনা অভিযানের শুরুতে হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সেই রাতে একই সঙ্গে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ও পিলখানায় সশস্ত্র আক্রমণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ওয়্যারলেস অপারেটর ছিলেন শাহজাহান মিয়া। ওয়্যারলেসে সারাদেশে ঘোষণা করা হয়- ‘ও বেস ফর অল স্টেশনস অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, কিপ লিসেনিং, হুইচ, উই আর অলরেডি অ্যাটাক্টেড বাই দ্য পাক আর্মি, ট্রাই টু সেভ ইউরসেলফ, ওভার।’

শাহজাহান মিয়া আমাদের সময়কে বলেছিলেন, রাত যখন সাড়ে ৮টা, তখন একটা সংবাদ পাই যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ির বহর বেরিয়ে আসছে। রাতে রাজারবাগ অথবা পিলখানায় আক্রমণ করবে। খবর পাওয়ার পর প্রথমেই টেলিকমের সব সহকর্মীকে জানিয়ে দিলাম। এর পর রাজারবাগের ব্যারাকে থাকা সব পুলিশ সদস্য সিদ্ধান্ত নেন যে কোনো মূল্যে তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। এএসআই ইয়াসিন আলী তরফদার, মতিউর রহমানসহ আমরা পাঁচ-সাতজন চলে যাই ওয়্যারলেসে। সেখানে গিয়ে দেশের সব জেলা ও সাব-ডিভিশনে আপডেট খবর জানাই।

ওই বার্তা পাওয়ার পর চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাই প্রথম হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মাতৃভূমি রক্ষায় বুকে অসীম সাহস আর হাতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে তারা দৃপ্তচিত্তে মুখোমুখি হন শত্রুর। পুলিশের এই বীরত্বগাথার নানা উপাদান নিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

সেই রাতে পাগলা ঘণ্টা বাজাতে শুরু করেন তৎকালীন আইজিপির বডিগার্ড কনস্টেবল আব্দুল আলী। সেই ঘণ্টার শব্দে পুলিশ সদস্যরা সজাগ হয়ে ওঠেন, অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিয়ে শত্রুর মোকাবিলায় তৎপর হন। থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলি ছুড়ে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের সূচনা করেন পুলিশ সদস্যরা। কনস্টেবল আব্দুল আলীর বাজানো সেই পাগলা ঘণ্টাও যতেœ স্থান পেয়েছে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।

ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার এসআই শিরু মিয়া ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গতি রোধের জন্য মালিবাগ মোড়ে ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে তিনি ছেলে কামালসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ছেলেসহ আটক হন শিরু মিয়া। নির্মম নির্যাতনের পর তাদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত প্রায় ১৪ হাজার পুলিশ সদস্য কর্মস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের একজন ডিআইজি, চারজন সুপার, একজন অতিরিক্ত সুপার, একজন ডিএসপি, একজন এসডিপিও, ১২ জন পরিদর্শক এবং ৮১ জন এএসআইসহ মোট ১১ শতাধিক পুলিশ সদস্য দেশের জন্য শহীদ হন। এর মধ্যে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন পাঁচজন। তাদের মধ্যে তিনজন বীরবিক্রম এবং দুজন বীরপ্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় সারদায় অবস্থিত পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মরত ছিলেন ডিআইজি আবদুল খালেক।