সিরাজগঞ্জে আঁধার কাটবে সোলার বিদ্যুতে

লুৎফর রহমান কাকন
২৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
সিরাজগঞ্জে আঁধার কাটবে সোলার বিদ্যুতে

চীন ও বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগে সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদ এলাকায় ৬৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাস্তবায়নের কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে। যমুনা নদীর পাড়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) ২১৪ একর জমি লিজ নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ-চায়না রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেড (বিসিআরইসিএল)। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছে, আগামী মে মাসে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, চীন থেকে আমদানি করা প্রায় ২৭ হাজার পিলারে বসানো হচ্ছে দেড় লাখের বেশি সোলার প্যানেল। প্রতিটি পিলারের উচ্চতা প্রায় ৯ মিটার। এর মধ্যে মাটির নিচে বসানো হয়েছে তিন থেকে চার মিটার; আর বাকিটা ওপরে। ফলে নিচের জমিতে করা যাবে কৃষিকাজ।

প্রকল্পটিতে খরচ ধরা হয়েছে ৮৭ দশমিক ৭১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (ডলারের সে সময়ের বিনিময় হার ১০৫ টাকা হিসেবে প্রায় ৯২১ কোটি টাকা)। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৫০ শতাংশ মালিকানায় রয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং বাকি অর্ধেক মালিকানা চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি)। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমিস্বল্পতা বিবেচনায় এই প্রকল্প কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদাহরণ হতে পারে।

আগামী এপ্রিলের শেষদিকে প্রকল্পের সব প্যানেল বসানো কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. তানবীর রহমান। তিনি বলেন, কন্ট্রোল বিল্ডিং, অফিসার ডরমিটরি, রেস্ট হাউস ও নিরাপত্তা ভবনসহ অন্যান্য কাজও শেষপর্যায়ে। প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে বলে জানান এনডব্লিউপিজিসিএলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মোহাইমেনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আশা করছি এপ্রিলের শেষের দিকে সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। সব কিছু ঠিক থাকলে মে মাসে সিওডি-তে (কমার্শিয়াল অপারেশন ডেট) যাব।’

কেন্দ্রটি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি সই হওয়া চুক্তি অনুযায়ী প্রতি ইউনিট ১০ দশমিক ২০ ইউএস সেন্ট মূল্যে কেনা হবে। ডলারের বর্তমান বিনিময় হার ১১০ টাকা হিসাবে প্রতি ইউনিটের দাম ১১ দশমিক ২২ টাকা।

দেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের সঙ্গে সমান অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বিসিআরইসিএল গঠন করে সরকার। প্রতিষ্ঠানটি শুরুতে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্ক বিসিআরইসিএলের প্রথম বিদ্যুৎ প্রকল্প। প্রকল্পে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন দেশি-বিদেশি চার শতাধিক প্রকৌশলী ও শ্রমিক।

বিসিআরইসিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, ‘নবায়ণযোগ্য জ্বালানিতে মোট ৩০০০ মেগাওয়াট প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমোদন পাওয়া গেছে। আমরা আশা করছি, যথাসময়েই সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে।’

সিরাজগঞ্জ সোলার পার্ক প্রকল্পের যৌথ মালিকানায় রয়েছে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড ও চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন। সিরাজগঞ্জ ছাড়াও পাবনা ও কুড়িগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় সোলার পার্ক স্থাপনের মাধ্যমে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে কোম্পানিটি।

বিসিআরইসিএলের প্রকল্পসমূহ

পাশের জেলা পাবনায় ৬৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরও একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ চলছে। ওই কেন্দ্রটি বছরের শেষ নাগাদ উৎপাদনে যাবে। এ ছাড়া পটুয়াখালীর পায়রায় ৫০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পসহ আরও কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিসিআরইসিএল সংশ্লিষ্টরা বললেন, সব মিলিয়ে এক হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

বিদ্যুৎ খাতে সরকারের মহাপরিকল্পনায়, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা রয়েছে। তবে সে লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি। বর্তমানে দেশে ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যে সৌর উৎস থেকে অনগ্রিড ও অফগ্রিড মিলিয়ে কমবেশি ৭১৬ মেগাওয়াটসহ বায়ু ও জলবিদ্যুৎ মিলিয়ে দেশে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুতের পরিমাণ এখন প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, বর্তমান সক্ষমতার অনুপাতে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাওয়ার কথা।

প্রচলিত ধারণা-বর্তমান প্রযুক্তি

একসময় ধারণা করা হতো, সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিচে কোনো ফসল আবাদ করা সম্ভব নয়। কারণ হিসেবে বলা হতো, সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্যানেল বসানোর ফলে এর নিচে তাপমাত্রা বেড়ে যায়; যা ফল-ফসল আবাদের পরিবেশকে নষ্ট করে।

কিন্তু এই সমস্যা এখন আর নেই। নতুন গবেষণা বলছে, উঁচু প্যানেল বসানো হলে নিচে ফসল আবাদ করা সম্ভব। যে সৌর প্রকল্পের নিচে উদ্ভিদ থাকে, ওই কেন্দ্রের উৎপাদন দক্ষতা এক ভাগ বৃদ্ধি পায়। নিচে পানি থাকলে দক্ষতার হার আরও একটু বেশি হয়।

দেশে প্রায় সব সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জমি ফেলে রাখা হয়েছে। সেখানে কোনো ফসল আবাদ করা হয় না। নিচু করে সোলার প্যানেল বসানোর কারণে ফসল আবাদ করার সুযোগও তেমন নেই। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সিরাজগঞ্জ ৭.৬ মেগাওয়াট গ্রিড কানেক্টেড সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, যা ইতোমধ্যে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে এটি বাস্তবায়ন করেছিলেন এনডব্লিউপিজিসিএলের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ এম খোরশেদুল আলম। এই কেন্দ্রটিতে উঁচু পিলারের ওপর সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। এর নিচে বিভিন্ন মৌসুমি শাকসবজি চাষ হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর দক্ষিণে সয়দাবাদ ইউনিয়নের বড়শিমুল ও পঞ্চসোনা মৌজায় ২২.৭৮ একর জমিতে কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়।