‘সাদি মহম্মদ পদকের অনেক ঊর্ধ্বে’
সাদি মহম্মদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সংগীতের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হয়েছে। অভিমান থেকে রবীন্দ্রসংগীতের এই শিল্পী গেল বুধবার আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। সেসময় সাদি মহম্মদের ভাই নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ জানান, গত বছর ৮ জুলাই মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ (৯৬) বার্ধক্যজনিত রোগে মারা যান। অল্প কিছুদিন পর বোনেরও মৃত্যু হয়। এরপর থেকে ট্রমার মধ্যে চলে যান সাদি। তিনি মানসিকভাবে ঠিক স্বাভাবিক ছিলেন না। আর তাই হয়তো তার অভিমানী বিদায়।
এর মধ্যে কথা রটেছে, কাজের স্বীকৃতি পাননি বলে অভিমানী বিদায় নিয়েছেন সাদি মহম্মদ। বিশেষ করে এ বছর নৃত্যকলায় একুশে পদক পেয়েছেন ছোট ভাই শিবলী মোহাম্মদ। সাদি মহম্মদের আগে, ছোট ভাইয়ের একুশে পদক পাওয়াটা ছিল তার জন্য বিব্রতকর!
এ বিষয়ে গণমাধ্যমে কথাও বলেন নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ। তিনি বলেন, ‘আমি এ বছর একুশে পদক পেয়েছি। কিন্তু সাদি মহম্মদ তো আমার বড়। আমি যখন পদক নিতে যাই সেটা আমার জন্য যে কতটা বিব্রতকর ছিল, বলে বোঝাতে পারব না! আমার কত লজ্জা হয়েছে যেতে!’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এমনও বলেছি, ভাই আমি নেব না এ পদক। সে আমাকে বলল, কেন তুই নিবি না। তুই তো নাচের জন্য দেশের হয়ে কম করিসনি। আমি তাকে বললাম, তুমিও তো রবীন্দ্রসংগীতের জন্য কম কর নাই। উত্তরে আমাকে বলল, তুই পেলেই আমি খুশি। পদক প্রদান অনুষ্ঠানের দাওয়াত কার্ড এল। ওকে দাওয়াত কার্ড দেওয়ার পর বলল, থাকরে তুই যা। তুই নিলে আমি অনেক খুশি হব। সেখানে লোকে আমাকে দেখে হয়তো প্রশ্ন করবে, করুণা দেখাবে, জানতে চাইবে, আপনাকে কেন দেওয়া হয়নি। আমি এগুলো নিতে পারব না।’
আরও পড়ুন:
ওটিটি প্ল্যাটফরম আমার জন্য বেশ লাকি
এদিকে শিল্পীর ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মা ও বোনের মৃত্যুর পর তার মধ্যে আত্মহত্যার বিষয়টি প্রবল হয়ে ওঠে। এর মধ্যে সংগীত ক্যারিয়ারে যথাযথ সম্মান পাননি- এই দুঃখটিও ছিল তার। তবে সম্প্রতি নেটদুনিয়ায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে সাদির পদক পাওয়া না পাওয়া নিয়ে!
শিবলীর কথায়, ‘সাদি ছিলেন আমার বন্ধুর মতো, পরামর্শক। আমরা সংগীতের এক ডালের দুই দিক বেছে নিয়েছিলাম, গান ও নাচ। ভাই যেহেতু রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, সেহেতু আমার নাচের কস্টিউম কেমন হবে? এক্সপ্রেশন কেমন হবে? রবীন্দ্রনাথের গানের কথার মূলভাব যত্ন করে বুঝিয়ে দিতেন। আমরা একসঙ্গে ছবি দেখতাম, গান শুনতাম। আমি কী খাব, তিনি কী খাবেন- সবকিছুই আমাদের এক ছন্দে চলত। মায়ের চলে যাওয়াটা আমাদের থামিয়ে দিয়ে গেছে। আমি তো কাজে ব্যস্ত থেকে কিছুটা উতরে গিয়েছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের একটি বন্ধুমহল ছিল। শাকিলা শর্মা, তপন, সুকল্যাণ, হিরু, কাজল আপাসহ বেশ কয়েকজনের একটি সার্কেল। মা হারাবার পর আমারও ডিপ্রেশন-একাকিত্ব ঘিরে ধরে। আমি চেষ্টা করেছি ক্লাসে গিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে সবকিছু ভুলে থাকতে। সাদি শুধু ক্লাসের পরের সময়টুকু একা থাকতেই পছন্দ করতেন।’
আরও পড়ুন:
নানাকে নিয়ে পরীর আবেগঘন পোস্ট
আক্ষেপ নিয়ে এই নৃত্যশিল্পী বলেন, ‘এই বেদনার দিনে যেটা আমাকে বেশি পীড়া দিচ্ছে। সেটি হলো বিভিন্ন গণমাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পদক পাওয়ার ইস্যুতে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য রটানো হচ্ছে। এটা একদমই সত্যি নয়, আমরা কোনো পদকের জন্য কাজ করিনি। আমার ভাইয়ের এসব যন্ত্রণা একদম ছিল না। একটি মেডেল নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ইস্যু তৈরি করছে। সাদির রবীন্দ্রসংগীত শোনেন কোটি কোটি বাঙালি। এ রকম শিল্পীর পদকের জন্য আহাজারি থাকার কথা নয়। তিনি পদকের জন্য কোনোভাবেই কষ্ট পাননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘হ্যাঁ, স্বীকৃতি পেলে ভালো লাগে। আমি একুশে পদক পেয়েছি, সেজন্য সম্মানিত বোধ করছি। তিনি উদার মনের মানুষ। তিনি আমাকে বলেছেন, “তুমি তো নাচের জন্য অনেক করেছ।” সাদি মহম্মদের জনপ্রিয়তা পৃথিবীর কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। পদক নিয়ে কথা হলে সরকারও বিব্রত হবে, সাদিকেও ছোট করা হবে। সাদি মহম্মদ সবকিছুর ঊর্ধ্বে একজন শিল্পী। সাদি মহম্মদ পদকের অনেক ঊর্ধ্বে- তাই পদকের বিষয়ে বিভ্রান্তিকর রটনা আর কেউ করবেন না, এটি সাদি মহম্মদের ভক্তদেরও অনুরোধ।’
ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ টেনে শিবলী মহম্মদ বলেন, ‘আমাদের সমাজে বিয়ে না করলে মানুষ চরিত্র নিয়ে নানা কথা রটায়। মানুষ সংসার করবে কি করবে না, সেটি তার ব্যক্তিগত ব্যাপার- এই প্রশ্ন তোলাটাই অন্যায়। আমি যদি বলি- মাকে ঘিরেই ছিল আমাদের সংসার। মা ছিলেন আমাদের পৃথিবী। আমাদের মা ৯৬ বছর বেঁচে ছিলেন। তাকে আমরা মাথায় করে রেখেছি। আমাদের সংসার মাকে কেন্দ্র করে। আর মাকেন্দ্রিক সংসারই ছিল অনেক আনন্দের।’
আরও পড়ুন:
‘এভাবে বিয়ে করা নাকি অর্থহীন’
সবশেষ তিনি বলেন, ‘শেষে বলতে চাই। ভাইটা আমার বড় ভালো মানুষ ছিলেন। তার ঈশ্বর প্রদত্ত গলা ছিল। উনি আমাদের একদম একা করে চলে গেলেন। আমাদের কথা একটুও ভাবলেন না। ভাইয়ের প্রতি আমার বড্ড অভিমান রয়ে গেল।’