এক নথিতে আটকে আছে তদন্তকাজ

শাহজাহান আকন্দ শুভ ও সৈয়দ রিফাত
০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
এক নথিতে আটকে আছে তদন্তকাজ

রাজধানীর সিদ্দিকবাজারের সাততলা ভবনে বিস্ফোরণে ২৫ জনের মৃত্যুর ঘটনার এক বছর পূর্তি আজ বৃহস্পতিবার। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তকাজ এখনো শেষ হয়নি। শাস্তি হয়নি যাদের অবহেলায় ২৫টি প্রাণ ঝরে গেছে, তাদের। পুলিশের তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ বলছে, মামলার তদন্ত শেষপর্যায়ে। ঘটনায় কার কী দায়-দায়িত্ব ছিল, তা নিরূপণ করা হয়েছে। কিছু প্রশ্নের জবাব না মেলায় তিতাস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে এসবের জবাব জানতে চেয়েছেন তদন্তকারীরা। প্রত্যুত্তরে তিতাস কর্তৃপক্ষের চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রশ্নের জবাব দিতে একটি পুরনো নথি প্রয়োজন যা তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। এ নথিতেই আটকে আছে তদন্তের অগ্রগতি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

গত বছরের ৭ মার্চ বিকালে নর্থ সাউথ রোডের ১৮০/১ হোল্ডিংয়ের ওই ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের পর পরই প্রথম দুটি তলার ছাদ ধসে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলে ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ জনের মৃত্যু হয়; গুরুতর আহত হন আরও অন্তত ৩০ জন। এ কাণ্ডের পর বংশাল থানার এসআই পলাশ সাহা অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় ভবনের মালিক প্রয়াত রেজাউর রহমানের দুই ছেলে ওয়াহিদুর রহমান ও মতিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এছাড়া গ্রেপ্তার করা হয় ভবনের বেজমেন্টে বাংলাদেশ স্যানিটারি দোকানের মালিক আব্দুল মোতালেব মিন্টুকে। তারা সবাই বর্তমানে জামিনে আছেন।

তদন্তকালে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক এসএম রাইসুল ইসলাম ভবন মালিকের অবহেলার প্রমাণ পান। এছাড়া রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও তিতাস কর্তৃপক্ষের তদারকির ঘাটতিও দেখতে পান তিনি। ভবনটি সাততলা হলেও রাজউকের অনুমোদনের কাগজপত্র রয়েছে পাঁচতলা পর্যন্ত। এছাড়া ভবনটির নকশা পরিবর্তন করারও প্রমাণ পেয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। বিস্ফোরণকাণ্ডে কোনো বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ ব্যবহার হয়েছে কিনা, তা পরীক্ষা করার জন্য ঘটনাস্থল থেকে জব্দকৃত আলামত বিস্ফোরক অধিদপ্তর, সিআইডি ও বিএসটিআইতে পাঠানো হয়। পরে সংস্থাগুলো তদন্ত কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে জানায়, আলামতে কোনো বিস্ফোরকের উপাদান পাওয়া যায়নি।

জানা যায়, আশির দশকে এই ভবনটি ছিল টিনশেড। সেখানে কুইনস রেস্তোরাঁ নামে একটি খাওয়ার হোটেল ছিল। রেস্টুরেন্টের জন্য বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগ নেওয়া হয় তিতাস থেকে। ২০০২ সালের দিকে বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগ আবাসিকে রূপান্তর করা হয় তিতাসে আবেদন করে। ওই সময় সেখানে বহুতল ভবন গড়ে ওঠে। এরপর ২০০৪ সালের দিকে নিচতলা থেকে গ্যাস সংযোগ চতুর্থ তলা পর্যন্ত উন্নীত করা হয়। কিন্তু রাইজার থেকে ভবন পর্যন্ত বাণিজ্যিক গ্যাসের সংযোগ লাইনের ১.৫ ইঞ্চি ব্যাসের মোটা পাইপ বিচ্ছিন্ন না করেই তার সাথে আবাসিক সংযোগের পৌনে এক ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ সংযুক্ত করা হয়। এছাড়া রাইজার থেকে ভবনে আসা গ্যাসের সংযোগ পাইপটির এক জায়গায় কাঠের টুকরো দিয়ে ছিদ্র বন্ধ করা হয়। ফলে মাটির নিচে থাকা ওই পরিত্যক্ত গ্যাসের সংযোগ লাইনে দীর্ঘদিন ধরে জমতে থাকা গ্যাস এক পর্যায়ে বিস্ফোরণ ঘটায় বলে পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে।

পরবর্তীতে বাণিজ্যিক থেকে আবাসিক সংযোগে রূপান্তরের প্রক্রিয়ার দায়িত্বে থাকা তিতাসের তফসিলভুক্ত ঠিকাদারের তথ্য চেয়ে তিতাস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় পুলিশ। ফিরতি চিঠিতে নথি পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানায় তিতাস কর্তৃপক্ষ। এই নথিতেই আটকে আছে তদন্তের অগ্রগতি। এদিকে গত সেপ্টেম্বর মাসে তিতাসকে এ সংক্রান্ত তথ্য দেওয়ার আদেশ দেন আদালত। কিন্তু আদালতের সেই আদেশও মানা হয়নি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক এসএম রাইসুল আমাদের সময়কে বলেন, তদন্তকালে ভবন মালিকের অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া কিছু সংস্থার তদারকির ঘাটতি পাওয়া গেছে। শিগগিরই এ মামলার তদন্ত শেষে চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে বলে তিনি জানান।

এদিকে গতকাল বুধবার সরেজমিনে সিদ্দিক বাজার গিয়ে দেখা যায়, সাততলা ভবনটির নিচতলার পুরোটাই কার্ডবোর্ড এবং চটের বস্তা দিয়ে ঘেরা। ভবনের সামনে ফুটপাত চলাচলের জন্য উন্মুক্ত থাকলেও কংক্রিট ডিভাইডার দিয়ে ঘেরা ভবনের সামনের সড়কের অংশবিশেষ। যদিও ঘেরা অংশে ফেলা হচ্ছে বর্জ্য। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের নিচ দিয়েই চলাচল করতে দেখা যায় পথচারীদের। ভবনের সামনে চোখে পড়ে রাজউকের ‘কাজ চলছে’ লেখা নোটিশ। তবে চটের বস্তার আড়াল থেকে ভবনের ভেতরে তাকাতেই চোখে পড়ে ধসে পড়া ছাদের বড় বড় খণ্ড ঝুলে আছে লোহার সাথে। ভেতরে শুনসান। ভবনের পাশের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা জানান, চলাচলের সময় যেন কেউ ভয় না পান, এ জন্য নিচতলা বোর্ড ও বস্তা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।

ঘটনার দিন নিহত হন রাজধানীর মিরহাজারীবাগের বাসিন্দা ভ্যানচালক ইদ্রিস মীর। বছর পেরোলেও বাবা হারানোর শোক এখনও ভুলতে পারেনি তার দুই সন্তান রিফাত ও আনাস। ইদ্রিস মীরের বড় ছেলে রিফাত বলেন, বাবার আকস্মিক মৃত্যু এখনও আমরা মেনে নিতে পারিনি। আমার ছোট ভাইটা এখনও বাবাকে খোঁজে। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে কাঁদতে কাঁদতে জেগে ওঠে।