ব্যর্থতা ঢাকতে সমন্বয়হীন অভিযানের প্রতিযোগিতা
রাজধানীর বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর ঘুম ভেঙেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর। বহুতল ভবন ও রেস্তোরাঁয় অনিয়ম ধরতে জোরদার অভিযান শুরু করেছে রাজউক ও পুলিশসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। এ নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। যদিও কোন সংস্থার আগে কোন সংস্থার অভিযান চালানো উচিত, এ নিয়ে নেই কোনো সমন্বয়।
অভিযানের কারণে রাজধানীর অভিজাত অনেক রেস্তোরাঁই বন্ধ হয়ে গেছে। গতকালও কেএফসি, ডোমিনোস পিৎজা ও কাচ্চি ভাইকে জরিমানা করা হয়েছে। মালিকরা পালিয়ে থাকলেও প্রতিদিনই গ্রেপ্তার হচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, ঢাকার রেস্টুরেন্টে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার অভিযানের নামে বাড়াবাড়ি করছে। তাদের অভিযোগ, দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসা পরিচালনা করতে হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়মের ফলে কিছু রেস্তোরাঁ সঠিক নিয়মে গড়ে ওঠেনি। এখন ঢালাও অভিযানের মাধ্যমে রেস্তোরাঁ ব্যবসা ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে। তৈরি হচ্ছে নতুন চাঁদাবাজির ক্ষেত্র। মালিক সমিতির পক্ষে বলা হয়েছে, রাজধানীর অন্তত ৪৫টি রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একটি রেস্তোরাঁয় বিভিন্ন সংস্থার ১২টি লাইসেন্স থাকার পরও সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাঁচ শতাধিক রেস্তোরাঁয় হয়রানির ভয়ে মালিকরাই বন্ধ রেখেছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের (ডিএমপি) বলছে, বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের পর গত রবিবার থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও রেস্তোরাঁয় অভিযান চালানো হয়। মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন দিনে ১৩৪৭ প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ৮৭২ জনকে গ্রেপ্তার ও ৮৮৭টি প্রসিকিউশন দেওয়া হয়।
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমানে দেশে ৪ লাখ ৮১ হাজার রেস্তোরাঁয় ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২ কোটি মানুষ এ পেশার ওপর নির্ভরশীল। বেকারি শিল্পের মতো রেস্তোরাঁ শিল্পও ধ্বংসের পাঁয়তারা হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানির হাতে ব্যবসা তুলে দেওয়ার জন্যই ঢালাও অভিযান চালানো হচ্ছে। এসব অভিযান লোক দেখানো। হয়রানি না করে টাস্কফোর্স গঠন করে রেস্তোরাঁ ব্যবসা চালু রাখার ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
ইমরান হাসান আরও বলেন, আমরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ৫৬৭টি চিঠি দিয়েছি। একটি মন্ত্রণালয় থেকেও আমাদের কোনো সহযোগিতা করা হয়নি। আমরা একটি স্পষ্ট নীতিমালার আওতায় আসতে চাই। আমরা সমালোচনা করতে চাই, আমরা কথা বলতে চাই এবং সমাধান চাই। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে আমরা যে ইমেজ তৈরি করেছি, অভিযানের নামে সেটি নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, মো. সৈকত (৩০) উত্তরা পশ্চিম থানাধীন ১০ নং সেক্টরস্থ বাইচ অ্যান্ড নুড্লস রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। এ রেস্টুরেন্টের সামনের ফুটপাতে গ্যাস সিলিন্ডার ও গ্যাসের চুলা পাশাপাশি রেখে রান্না করার জন্য তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জনসাধারণের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য তাকে ডিএমপি অধ্যাদেশের ১০০ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
রেস্তোরাঁর কর্মচারীরা জানান, মালিকরা সাধারণত রেস্তোরাঁয় আসেন না। অভিযানের পর ম্যানেজারসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও রেস্তোরাঁয় থাকেন না। স্বল্প পরিসরে কর্মচারীদের দিয়ে মালিকরা রেস্তোরাঁ চালাচ্ছেন। পেটের দায় আর চাকরি হারানোর ভয়ে কর্মচারীরা রেস্তোরাঁয় কাজ করছেন। অভিযানের সময় তাদেরই ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ধানমন্ডি থানার ২(৩) ২০২৪ নম্বর মামলার আসামি মো. খালেদ হোসেনের আইনজীবী হারুন অর রশিদ বলেন, আদি কড়াই গোস্ত নামের রেস্টুরেন্টে তার মক্কেল সার্ভিস বয় হিসেবে কাজ করতেন। গত রবিবার তাকে কর্মস্থল থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরপর গত সোমবার তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। এখানে আসামি খালেদ হোসেন একজন কর্মচারী মাত্র। তার কি দায় থাকতে পারে? দায় থাকলে মালিকের থাকতে পারে। গ্রেপ্তার করলে তাদের করা উচিত। কর্মচারীদের গ্রেপ্তার হয়রানি ছাড়া কিছুই নয়।
সমন্বয়হীন অভিযানের অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্য থেকেও। অতীতের কা-ে দোষীরা সাজা না পাওয়ায় বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন পরিবেশবিদ ও পরিকল্পনাবিদরা। তাদের মতে, ভবনে অগ্নিকাণ্ড এবং এসব কাণ্ডে হতাহতের জন্য অনুমোদন প্রদানকারী ৭টি সংস্থা দায়ী। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও ভবন মালিককে ‘অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের’ জন্য আসামি করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা। পাশাপাশি সময়ক্ষেপণ না করে অতিদ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে। গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘ভবন বিপজ্জনকতায় আচ্ছন্ন নগরী: প্রেক্ষিতে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন পরিবেশবিদ ও পরিকল্পনাবিদরা।
সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, এ ধরনের প্রতিটি অগ্নিদুর্ঘটনায় হতাহতের পিছনে রয়েছে মুনাফাখোরদের অতি লোভ। তারা যেন কোটিপতি হওয়ার দৌড়ে নেমেছে। কে মরল তা যেন তাদের দেখার বিষয় না। এই লোভে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করছে সাধারণ মানুষ, আর আসামি করা হচ্ছে সাধারণ কর্মচারীদের। এতে করে প্রকৃত দোষীরা অধরাই রয়ে যাচ্ছে। তিনি সবাইকে সম্মিলিতভাবে এই মৃত্যুপথ থেকে উত্তরণে কাজ করার আহ্বান জানান।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তার সংস্থাগুলোর মাধ্যমে মূলত অনুমোদন দেয়, নোটিশের কিছু কাগজ তৈরি করে। কিন্তু পৃথিবীতে যেসব শহরে সুশাসন এবং মানুষের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত, সেখানকার সংস্থাগুলো শুধু কাগজ তৈরি করে না; নিয়মিত পরিদর্শন করে, কারও দোষ পেলে শাস্তি দেয়। কিন্তু আমাদের সেই সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, দুপুরে সাত মসজিদ রোডের বাংলা খাবারের একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলাম। রেস্তোরাঁটি মূল রাস্তার পাশে তেতলায়। লিফট আছে, সিঁড়িও আছে। খাওয়ার সময় একটি বাহিনীর পোশাক পরা সদস্যরা এসে এটা-সেটা দেখছিলেন। সঙ্গে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন না। কিছুটা শঙ্কিত, কিছুটা বিরক্ত ম্যানেজার বলছিলেন, গতকালই তো এক দল এসে কাগজপত্র, কিচেন, ফায়ার এক্সিট ইত্যাদি দেখে গেছে। তখন পরিদর্শনকারী টিমের দলনেতা জানালেন, তারা ভিন্ন দল।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
পুলিশের এই সাবেক কর্মকর্তা বলেন, বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের পর স্পষ্টত কোনো রকম সমন্বয় ছাড়া বিভিন্ন সংস্থার বিভিন্ন দল রেস্তোরাঁগুলোয় হানা দিচ্ছে। এতে হয়রানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আশা করি, পরিদর্শনকারী সংস্থার তদারককারী কর্মকর্তারা বিষয়টি নজরদারিতে রাখবেন।
তবে পুলিশ, রাজউক ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, রেস্তোরাঁ বানাতে গিয়ে কিছু ভবনের নকশাই বদলে ফেলা হয়েছে। একটি আবাসিক ভবনের নকশা আর রেস্তোরাঁর নকশার পার্থক্য রয়েছে। প্রকৌশলীর অনুমোদন ছাড়া বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে এভাবে রেস্তোরাঁ তৈরি করলে অগ্নিঝুঁকি বাড়ে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই রেস্তোরাঁ ও ভবনে অভিযান চালানো হচ্ছে। অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অভিযানে সমন্বয়হীনতা ও বাড়াবাড়ি হয়ে থাকলে সেটার বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অভিযানের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর থেকে অত্যন্ত কঠোরভাবে এসব বিষয় দেখভাল করছে। এক্ষেত্রে যে জায়গায় আইনের ব্যত্যয় পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে এবং ভুল সংশোধনের উদ্দেশ্যেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব ভুল শুধরে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবার আবেদন করলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ভবন খুলে দেওয়া হবে।
এদিকে গতকালও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় খিলগাঁওয়ে কেএফসি ও ডোমিনোস পিৎজাকে দুই লাখ টাকা করে এবং গুলশান ২-এ কাচ্চি ভাইকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া গুলশানের হোসেন ভবন ও গোল্ডেন প্লাজাকে অগ্নি ঝুঁঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
বুধবার দুপুর ১২টার দিকে গুলশান ও বনানী এলাকার বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় অভিযান চালায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এ সময় ট্রেড লাইসেন্স না থাকায় গুলশান ২-এ কাচ্চি ভাইকে এক লাখ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ৩ মাসের জেল দেওয়া হয়।
গুলশান ১-এ অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্টকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অপর একটি ভবনের ইমারজেন্সি এক্সিট বন্ধ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করায় দোকান মালিককে জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে ৬ মাসের সাজা দেওয়া হয়েছে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর নিউ সুপার দক্ষিণ মার্কেটে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। এ সময় বিধিমালা ভেঙে সিঁড়িতে ভাসমান দোকান করায় ১৩টি দোকান মালিককে ৫ হাজার টাকা করে ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে লাগা আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর ঘটনার পরই নড়েচড়ে বসে সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রেস্টুরেন্টগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিশেষ করে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা তদারকে অভিযান পরিচালনা করছে সংস্থাগুলো।