বাজার থাকলেও পাটের সুদিন ফিরছে না

রেজাউল রেজা
০৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বাজার থাকলেও পাটের সুদিন ফিরছে না

অতীতের জৌলুস হারিয়েছে পাট ও পাটজাত পণ্য। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে একের পর এক হোঁচট খেয়ে রপ্তানি আয়ে পিছিয়ে পড়েছে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসেও পতন অব্যাহত রয়েছে। দেশের রপ্তানিকারকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে বিপুল চাহিদা রয়েছে, অথচ পণ্যের অভাবে রপ্তানি আয় বাড়ানো যাচ্ছে না। মিল মালিকরাও বলছেন, সচল মিলের সংখ্যা কমছে। যেগুলো রয়েছে সেগুলোও শতভাগ উৎপাদনে নেই।

আজ বুধবার জাতীয় পাট দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার দেশ, স্মার্ট পাটশিল্পের বাংলাদেশ’। অন্যান্য বছরের মতো এবারও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করতে যাচ্ছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।

পাট খাতের বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, পাট নিয়ে আলাদা মন্ত্রণালয় থাকার পরও এতদিন ধরে এ খাতের এমন দশা কেন তা বুঝে আসে না। এমনকি বেসরকারি মিলগুলোও শতভাগ উৎপাদনে নেই। সরকারের নানা উদ্যোগও আলোর মুখ দেখছে না। এর পেছনের কারণগুলো আগে খুঁজে বের করতে হবে।

পরিবেশবান্ধব সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে বলে জানান ড. জাহিদ।

তিনি বলেন, এখানে পরিষ্কার যে, বাজার কিংবা চাহিদার কমার ফলে পাটে রপ্তানি আয় কমেনি, আমরাই বাজার ধরতে পারছি না, সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছি, উৎপাদনেও পিছিয়ে আছি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছর (জুলাই-জুন) পাট খাতে রপ্তানি আয় হয় ১১৬ কোটি ১৪ লাখ ডলার। যা আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি ছিল। এর পর থেকেই পতনের শুরু। যা আর টেনে তোলা সম্ভব হয়নি। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, পরের ২০২১-২২ অর্থবছরে পাটে রপ্তানি আয় ৩ শতাংশ কমে ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নামে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ১৯ দশমিক ১ শতংশ কমে ৯১ কোটি ২২ লাখ ডলারে দাড়ায়। যা চলতি অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে।

ইপিবির সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৫৮ কোটি ১৫ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ কম এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ দশমিক ০৩ শতাংশ কম। এই সময়ের ব্যবধানে পাটের তৈরি সুতা ও টোয়াইনের রপ্তানি সামান্য বাড়লেও কাঁচা পাট এবং পাটের বস্তা ও ব্যাগের রপ্তানি কমেছে।

রপ্তানিতে টানা ধসের পেছনে দেশের পাটকলগুলোর অচলাবস্থা অন্যতম কারণ বলে জানান বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান এস আহমেদ মজুমদার। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধি না করে সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে একের পর এক পাটকলগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিজিএমসি এখন অচল প্রায়। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ বেসরকারি মিলে ২০ শতাংশ উৎপাদন সক্ষমতাও নেই। অথচ আমাদের পুরনো মেশিনগুলো দিয়েই চাহিদা মেটানোর মতো উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর কম। ২০২৬ সালের পর ভর্তুকি উঠে যাবে। সুতরাং অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বাড়াতেই হবে।

আমদানিকারকরা বলছেন, পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে পার্শ্বর্তী দেশ ভারত। আফ্রিকা ও ইউরোপের বিকল্প বড় বাজার থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিতে ভারতের বাজারের ওপর অতিনির্ভরতার কারণে রপ্তানি আয়ে বড় পতন ঘটেছে। ভারত সরকার এন্টি ডাম্পিং আরোপ করলে রপ্তানি আয়ে বড় ধস দেখা দেয়।

চাহিদামাফিক পণ্য পাওয়া গেলে পাটে রপ্তানি আয় ২ বিলিয়নে উন্নীত করা সম্ভব বলে মনে করেন বিজেজিইএ চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, বর্তমানে সুদান, তানজানিয়া, উগান্ডাসহ আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে বিকল্প বাজার তৈরির চেষ্টা করছি। সুদানে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রপ্তানি হচ্ছে। তুরস্ক ও ইরানে সুতার বড় চাহিদা রয়েছে। ইউরোপেও পাটজাত পণ্যের চাহিদা আছে। কিন্তু আমরা উৎপাদনের অভাবে রপ্তানি করতে পারছি না।

বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) প্রেসিডেন্ট মো. আবুল হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, শতভাগ উৎপাদনে যেতে না পারলে এ খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। কাঁচা পাটের দাম সেভাবে বাড়েনি। সুতরাং আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো।

পাট দিবসকে সামনে রেখে গত সোমবার আয়োজিত এক সেমিনারে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, পরিবেশবান্ধব বিবেচনায় বিশ্বব্যাপী পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এ সুযোগ নেওয়ার জন্য পাটজাত পণ্যে বৈচিত্র্য আনা হবে এবং পাটশিল্পকে লাভজনক করার উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। পাটশিল্পে বেসরকারি খাতের উদ্যোগ উৎসাহিত করা হবে। পাটজাত পণ্যকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় নানামুখী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করেছে।