অগ্নিঝুঁকিতে ঢাকার ৫৫% ভবন

তালিকায় রয়েছে ১৩শ বিপণিবিতান ।। অনেক মার্কেট অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ

ইউসুফ সোহেল
০৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
অগ্নিঝুঁকিতে ঢাকার ৫৫% ভবন

পুরান ঢাকার নিমতলীর পর চুড়িহাট্টা, সিদ্দিকবাজারে ক্যাফে কুইন ভবন থেকে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ও নিউমার্কেট; সর্বশেষ বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ। রাজধানীতে একের পর এক অগ্নিকা-ে ঝরে গেছে কত শত প্রাণ। ছাই হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। কিন্তু যেসব কারণে ঘটছে এসব প্রাণঘাতী ও অর্থবিনাশী কা-, সেসব সমস্যার সমাধান হয়নি আজও। আগুনের ঝুঁকি প্রতিরোধে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) ও অগ্নি আইন (২০০৩) অনুযায়ী ৩০টির বেশি নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ করার কথা। কিন্তু কে এসবের তোয়াক্কা করে!

ফায়ার সার্ভিসের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঢাকার ভবনগুলোর ৫৫ শতাংশেরও বেশি অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ভবনও রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার উদাসীনতায় প্রায় প্রতিদিনই অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে চলেছে। ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, রাজউক, বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও বিদ্যুৎ বিভাগের উদাসীনতার কারণে ঘটছে একের পর এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি। অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে রাজধানীর শপিংমল ও মার্কেট সম্পূর্ণ অনিরাপদ অবস্থায় থাকায় যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে বেইলি রোডের চেয়েও বড় দুর্ঘটনা।

রাজধানীর ডেমরায় সারুলিয়ার টেংড়া রোডে পাশাপাশি অবস্থান ‘ছালেহা শপিং কমপ্লেক্স’ ও ‘মনু মোল্লা শপিং কমপ্লেক্স’। দুটি মার্কেটে দোকানের সংখ্যা সহস্রাধিক। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য বলছেÑ দুটি মার্কেটই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। নিয়ম অনুসারে প্রতিবছরই স্ব-স্ব এলাকার মার্কেট পরিদর্শন করে অগ্নিঝুঁকিসহ সার্বিক বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন কর্মকর্তাদের। নিয়মের ব্যত্যয় পেলে সংশোধনের নোটিশ প্রদানসহ মার্কেট ভবন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণেরও কথা রয়েছে। উদ্বেগজনক তথ্য হলোÑ ফায়ার সার্ভিসসহ ৫টি সংস্থার

সমন্বিত টিম গত ৪ মাস আগে ভবন দুটিতে অভিযান চালালেও এ পর্যন্ত তেমন কোনো নোটিশ পাননি বলে দাবি করছে ভবন দুটির মালিকপক্ষ। উপরন্তু ছালেহা শপিং কমপ্লেক্সের তৃতীয় তলার পুরো অংশ জুড়েই ‘দি রেডসান’ নামে একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড পার্টি সেন্টার। সেখানে দিন-রাত জ্বলছে বেশ কয়েকটি গ্যাসের চুলা। 

ফায়ার সার্ভিসের সর্বশেষ জরিপে উঠে এসেছে, ঢাকাসহ দেশের ৮টি বিভাগে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ৩৭৬টি বহুতল, শিল্পকারখানা, মার্কেট-শপিংমল, সরকারি ও অন্যান্য ভবন পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে অতি অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ভবনের সংখ্যা পাওয়া গেছে ৪২৪টি আর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ১ হাজার ৬৯৪টি। রাজধানীর ১ হাজার ২০৯টি ভবন পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস অতি অগ্নিঝুঁকির মধ্যে থাকা ১২৭টি ভবনের সন্ধান পেয়েছে আর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৬০২টি। সন্তোষজনক তালিকায় রয়েছে ৪৮০টি ভবন।

২০২২ সালে ৫ হাজার ৮৬৯টি বহুতল, শিল্পকারখানা, মার্কেট-শপিংমল, সরকারি ও অন্যান্য ভবন পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ অতি অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ভবন পেয়েছে ৬১৭টি; ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ১ হাজার ৬০৬টি। রাজধানীর ১ হাজার ১৬২টি ভবন পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস অতি অগ্নিঝুঁকির মধ্যে থাকা ১৩৬টি ভবনের সন্ধান পেয়েছিল; আর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ছিল ৪৯৯টি। অর্থাৎ ঢাকার ভবনগুলোর ৫৫ শতাংশেরও বেশি অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ভবনও আছে।

হাসপাতাল, মার্কেট, আবাসিক হোটেল ও উঁচু ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার ৯৬ শতাংশ বিপণিকেন্দ্র, ৯৮ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৯৮ শতাংশ হাসপাতাল-ক্লিনিক অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। পরিদর্শনের সময় ভবনের মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা, অবস্থানকারীর সংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্রের উপস্থিতি, মেঝের আয়তন, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, লিফট, ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা ইত্যাদি খতিয়ে দেখে ভবনগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে ফায়ার সার্ভিস।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, গত বছরের জরিপে রাজশাহী বিভাগে ৩৮৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫১টি ঝুঁঁকিপূর্ণ এবং ১১টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন পাওয়া গেছে। খুলনায় ৮৭৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ২৯৮টি, অতিঝুঁকিতে রয়েছে ৬টি। রংপুরে ৬৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৯৪টি, অতিঝুঁকিতে ১৯টি। সিলেটে ২৫৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪৪টি ঝুঁকিপূর্ণ। ময়মনসিংহে ৯৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ চারটি, অতিঝুঁকিতে আছে ৬টি ভবন। চট্টগ্রামে এক হাজার ৪৮৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৫২৪টি, অতিঝুঁকিতে ২৪৬টি। বরিশালে ৪৩৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৭৭টি, অতিঝুঁকিতে থাকা ৯টি ভবনের সন্ধান পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে প্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কেমন তার তালিকা করে। সেই তালিকা অনুযায়ী খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে একাধিকবার চিঠি ও চূড়ান্ত নোটিশ দিলেও তা কর্ণপাত করছে না কেউ। ফলে এ ধরনের ভবন ও বিপণিবিতানগুলোতেই ঘটছে বেশির ভাগ অগ্নিকা-। যার সর্বশেষ উদাহরণ বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ওই ভবনটিতে একাধিকবার নোটিশ পাঠানো হলেও আমলে নেয়নি কেউ। ফলে গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্যিক ওই মার্কেটে আগুন লেগে ঝরে যায় ৪৬ জন মানুষের প্রাণ। মৃত্যুযন্ত্রণা নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় এখনো কাতরাচ্ছেন ৫ জন।

গতকাল রবিবার দুপুরে সরেজমিন ডেমরার ‘ছালেহা শপিং কমপেক্স’-এ অবস্থিত ‘দি রেডসান’ চায়নিজ রেস্টুরেন্টে গিয়ে অগ্নিনির্বাপণের জন্য মাত্র একটি মাঝারি ধরনের ফায়ার এক্সটিংগুইশারের অস্তিত্ব মিলেছে, তাও আবার মেয়াদোত্তীর্ণ। মার্কেটের দেয়ালগুলোতে কয়েকটি এক্সটিংগুইশার দেখা গেলেও সেগুলো ছিল বেশ পুরনো; ধুলার আস্তরণ জমে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিলÑ পুরনো এক্সটিংগুইশারে সাঁটা হয়েছে মেয়াদের নতুন স্টিকার। এ বিষয়ে ‘দি রেডসান’-এর স্টাফ আল আমিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। দুবছর ধরে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। আগুন নির্বাপণ ব্যবস্থার প্রশিক্ষণ দিতে এ সময়কালে কেউ আসেনি, জানান তিনি। অনেক চেষ্টার পরও প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. ইয়াসিনের দেখা মেলেনি। ছালেহা শপিং কমপ্লেক্সের পাশেই মনু মোল্লা শপিং কমপ্লেক্স। এ মার্কেটের অবস্থাও তথৈবচ। শুধু এই দুটি মার্কেটই নয়, রাজধানীসহ সারাদেশের অধিকাংশ মার্কেটেই আজ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার বেহাল দশা। 

পুরনো এক্সটিংগুইশারে ২০২৪ সালের নতুন মেয়াদের স্টিকার লাগানোর কথা স্বীকার করে অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ডেমরার ‘ছালেহা শপিং কমপেক্স’ ও ‘মনু মোল্লা শপিং কমপ্লেক্স’-এর অংশীদার মালিক মো. আমীন মোল্লা গতকাল রবিবার আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারাই বলে গেছেন, এক্সটিংগুইশারের পুরনো বোতলে রিফিল করে ২০২৪ সালের স্টিকার লাগাতে। তাই আমরা লাগিয়েছি। আর আমাদের মার্কেট দুটি যে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ তা এর আগে কেউ আমাদের বলেনি। ৪ মাস আগেও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারাসহ ৫ সংস্থার টিম মার্কেটে বসে মিটিং করেছে, খেয়েছে। তখনো তো কেউ আমাদের এই বিষয়ে কিছু বলেননি। ‘দি রেডসান’ চায়নিজ রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড পার্টি সেন্টার বেশ পুরনো। সব নিয়ম মেনেই আমরা মার্কেট ও চায়নিজ রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করছি।

ফায়ার সার্ভিসের ডেমরা স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোহাম্মদ ওসমান গনি বলেন, মাঝারি ধরনের অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ‘ছালেহা শপিং কমপেক্স’ ও ‘মনু মোল্লা শপিং কমপ্লেক্স’-এ ফায়ার সার্ভিসসহ কয়েকটি সংস্থা মিলে অভিযান পরিচালনা করে অগ্নিঝুঁকির বিষয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছে। অভিযানের সময় ‘দি রেডসান’ চায়নিজ রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড পার্টি সেন্টার’ বন্ধ পাওয়া যায়। ভবন কর্তৃপক্ষ বলেছিলÑ প্রতিষ্ঠানটি সেখান থেকে সরিয়ে নেবে। এর পরও যদি তারা না সরায়, আমরা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করব।


পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)Ñএর কার্যকরী সভাপতি ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ঢাকার রেস্টুরেন্টগুলো এখন অগ্নিবোমার ডিপো। রাজধানীর বনানী, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায় রেস্তোরাঁসহ নানা বাণিজ্যিক কর্মকা- চলছে। সেসব ভবনের অগ্নিনিরাপত্তাসহ জননিরাপত্তার অনেক বিধিবিধান মানা হচ্ছে না। এসব ভবনে রান্নাঘর, এসি স্থাপনের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের বিধান মানা হয়েছে কিনা, তা নিরীক্ষা করা জরুরি। অনেক রেস্টুরেন্টের ভেতরে তৈরি হয়েছে ধূমপানের স্থান। মহানগরীর রেস্টুরেন্টগুলোর এমন অগ্নিবোমার ডিপোতে পরিণত হওয়া খুবই উদ্বেগজনক।

রেস্টুরেন্ট মালিকদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ও বেআইনি কর্মকা-ের বিরুদ্ধে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণে গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন মন্তব্য করে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, এ জাতীয় দুর্ঘটনা প্রতিরোধে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন (২০০৩) ও অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমালা (২০১৪) অনুসারে রেস্টুরেন্টসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর হতে অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এর অন্যথা হলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ মার্কেটই এখন রয়েছে অগ্নিকা-ের ঝুঁকিতে। এগুলোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, পানি ও ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম নেই। কিছু কিছু শপিংমল ও মার্কেটে অক্সিজেন সিলিন্ডার, পানির রিজার্ভ ট্যাংক, বালুভর্তি বালতি ও রেসকিউ সিঁড়িসহ অন্যান্য অগ্নিনির্বাপণ সামগ্রীও নেই। এসব নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতারা কিছুটা শঙ্কিত হলেও মালিক সমিতির কোনো উদ্যোগ নেই। অন্যদিকে দেখভালের দায়িত্বে থাকা ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, রাজউক, বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও বিদ্যুৎ বিভাগ উদাসীন।

ফায়ার সার্ভিসের এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর ১ হাজার ৩০০টি বিপণিবিতান রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে। মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে ৬২২টি মার্কেট ও শপিংমল। এই তালিকায় ছিল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ভূস্মীভূত মার্কেটগুলোও। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সরেজমিন রাজধানীর ১ হাজার ৩০৫টি বিপণিবিতান পরিদর্শন করে এ তথ্য পায় ফায়ার সার্ভিস। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বেইলি রোডে ট্র্যাজেডির পর ফের জরিপে নামে কর্তৃপক্ষ।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, প্রতিবছর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে হালনাগাদ করার পর সেসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের চিঠি দেওয়া হয়। ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা ছাড়া এনফোর্সিং এবং রেগুলেশন ক্যাপাসিটি ফায়ার সার্ভিসের নেই। পরবর্তী ব্যবস্থা রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নেওয়ার কথা। ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স ছাড়া অনেকেই ব্যবসা করে যাচ্ছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেখার কথা। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ এবং সেগুলো ব্যবহার সবারই জানা প্রয়োজন। প্রাথমিক পর্যায়ে অগ্নিনির্বাপণ করতে পারলে ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানি অনেকটাই কমে আসবে। যথাযথ আইন প্রয়োগ করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সিলগালা করাসহ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে অগ্নিকা-ের ঘটনা অনেকটাই রোধ করা সম্ভব হবে।

জরিপসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন অনুযায়ী দুর্ঘটনা রোধে মার্কেটের অবস্থান, ব্যবহৃত ফ্লোরের আয়তন, সাধারণ সিঁড়ির প্রশস্ততা, অগ্নিনির্বাপণ কাজে সিঁড়ির ব্যবস্থা, জরুরি প্রস্থানের সিঁড়ির সংখ্যা, প্রতি তলায় সেফটি লবির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা রয়েছে। তা ছাড়া ছাদে ওঠার একাধিক সিঁড়ি রাখা, ছাদের দরজা খোলা রাখা, বহির্গমনে পর্যাপ্ত দরজা রাখা, ৫০ হাজার গ্যালনের আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভ ট্যাংক রাখা, ১০ হাজার গ্যালনের ওভার হ্যাড ওয়াটার ট্যাংক থাকা বাধ্যতামূলক। একই সঙ্গে বৈদ্যুতিক তারে কনসিল ওয়্যারিং থাকা, বৈদ্যুতিক মেইন সুইচ বক্স ও ডিমান্ড বক্সের নিরাপদ অবস্থানে থাকা, প্রতি পয়েন্টে ৫ কেজি পরিমাণের সিওটু ফায়ার এক্সটিংগুইশার সংরক্ষণ করা, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্র রাখা এবং মার্কেটের ব্যবসায়ী ও কর্মীদের নিয়মিত অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রশিক্ষণ করানোর কথা রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব নিয়ম মানা না হলেও প্রয়োগ হচ্ছে না আইন।


রাজধানীর ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ মার্কেট

জানা গেছে, রাজধানীতে ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ তালিকার মধ্যে রয়েছে কাপ্তানবাজার কমপ্লেক্স ভবন-২, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স আদর্শ ইউনিট, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স (যা ইতোমধ্যে পুড়ে গেছে), বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স গুলিস্তান ইউনিট, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মহানগর, মহানগর বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড, ঢাকা ট্রেড সেন্টার, গুলশান শপিং সেন্টার, এম প্রেজ প্লাজা, জব্বার টাওয়ার, রহমানিয়া সুপার মার্কেট, ভূইয়া ম্যানশন, পিংক সিটি শপিং কমপ্লেক্স, বিদিশা সুপার মার্কেট, সাবেরা টাওয়ার মার্কেট, বাইশ বর সুপার মার্কেট, ল্যান্ড মার্ক শপিং সেন্টার, বনানীর গোলাম কিবরিয়া ম্যানশন, বাংলাদেশ ইউএস মৈত্রী কমপ্লেক্স, বাড্ডার ফুজি ট্রেড সেন্টার, আবেদ আলী মার্কেট, আরএএস প্লাজা, লুৎফুন টাওয়ার, রিজভ্যালি শপিং সেন্টার, হাকিম টাওয়ার শপিং কমপ্লেক্স, বসুন্ধরার ভাই ভাই সুপার মার্কেট, হাজি আ. লতিফ ম্যানশন, আমীর ড্রিম কমপ্লেক্স, ফরাজী টোলা কাঁচাবাজার, ভাটারার আব্দুল লতিফ মার্কেট, বারিধারার নতুন বাজার দোকান মালিক সমিতি মার্কেট, মহাখালীর জননী ভবন মার্কেট, শাহীন ম্যানশন, মহাখালী প্লাজা, জেবা টাওয়ার, কারওয়ানবাজারের শাহ আলী টাওয়ার, নিক্য পেপার অ্যান্ড স্টেশনারি, মগবাজারের বাটা বাজার, বেঙ্গল টাওয়ার, আড়ং প্লাজা, বিশাল সেন্টার শপিংমল, রাজ্জাক প্লাজা শপিং কমপ্লেক্স, আহম্মেদ পরিবার মার্কেট, আলহাজ শামছুদ্দিন ম্যানশন, সিরাজ ম্যানশন মার্কেট, তেজগাঁওয়ের সেন্টার পয়েন্ট ও বে-এম্পোরিয়াল মার্কেট।

‘ঝুঁঁকিপূর্ণ’ তালিকায় রয়েছেÑ উত্তরার কেসি টাওয়ার, টপটেন শপিংমল, ১৩ নম্বর ফার্নিচার মার্কেট, উত্তরা বাজার সুপার মার্কেট, আকতার ফার্নিচার, একে টাওয়ার, ওয়েসটেস লিমিটেড, ওরিয়ন ফুটওয়্যার, মি অ্যান্ড মম, ফ্যাশন প্যারাডাইজ, তেজগাঁওয়ের আহমেদ মার্কেট, তোহা মিয়া মার্কেট, শেখ প্লাজা, মগবাজার প্লাজা, সাউদিয়া সুপার মার্কেট, রহমান ম্যানশন, আয়শা মঞ্জিল, হাজি মোতালেব মার্কেট, গুলশান টাওয়ার, জব্বার টাওয়ার শপিংমল, পুলিশ প্লাজা, রহমানিয়া সুপার মার্কেট, গুলশান-১ নম্বরে ডিএনসিসি মার্কেট, কাওরানবাজার ২ নম্বর সুপার মার্কেট, কাওরানবাজার কিচেন মার্কেট, কাওরানবাজার কামার পট্টি, হাসিনা মার্কেট, কাব্যকস সুপার মার্কেট, ব্র্যাক আড়ং, বনানী-বারিধারা-ডিএনসিসি বনানী সুপার মার্কেট, সাদ মুসা সিটি সেন্টার, মেহেদী মার্কেট, প্রগতি সরণির হাজি জমির উদ্দিন সুপার মার্কেট, ফজিলা শপিং সেন্টার, ওয়ারীর মুক্ত বাংলা হকার্স মার্কেট, কাপ্তানবাজার কমপ্লেক্স ভবন-১, খন্দকার ইলেকট্রনিক মার্কেট, শাহবাগের আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেট, নবাবপুরের আ. রহিম মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার, মজনু হার্ডওয়্যার মার্কেট, পল্টনের বায়তুল মোকাররম মার্কেট, পলওয়েল সুপার মার্কেট, সিটি ভবন, জাহাঙ্গীর শপিং কমপ্লেক্স, রমনা ভবন মার্কেট, মওলানা ভাসানী স্টেডিয়াম মার্কেট, ভলিবল মার্কেট, গুলিস্তানের এনএক্স টাওয়ার, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট, ঢাকা ট্রেড সেন্টার দক্ষিণ, ফুলবাড়িয়া সিটি সুপার মার্কেট-২, বঙ্গবন্ধু স্কয়ার পাতাল মার্কেট, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম মার্কেট, ডন প্লাজা, নবাব প্লাজা, পীর ইয়ামেনী মার্কেট, বংশালের জাকের সুপার মার্কেট, রোজলীন ভিসতা শপিং কমপ্লেক্স, মিরপুরের মিরপুর টাওয়ার নার্সিং মার্কেট, ডাসুরা টাওয়ার, সিটি ক্লাব মার্কেট, ইকবাল কমপ্লেক্স, চৌরঙ্গী মার্কেট, হাজি গণি মোল্লা মার্কেট, সৈকত প্লাজা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জামে মসজিদ কমপ্লেক্স।

ফায়ার সার্ভিস, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসআই) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (জিজিএফআই) সমন্বিত দল রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেট পরিদর্শন শেষে জানায়, রাজধানী সুপার মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, নিউমার্কেট, চকবাজার, ঠাঁটারীবাজারের কয়েকটি মার্কেটসহ রাজধানীর প্রায় সব কটি মার্কেটই অগ্নিকা-ের ঝুঁকিতে রয়েছে। এরেশ কয়েকটি গ্যাসের চুলা।

ফায়ার সার্ভিসের সর্বশেষ জরিপে উঠে এসেছে, ঢাকাসহ দেশের ৮টি বিভাগে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ৩৭৬টি বহুতল, শিল্পকারখানা, মার্কেট-শপিংমল, সরকারি ও অন্যান্য ভবন পরিদর্শন করে