বিভীষিকাময় সেই রাতের মৃত্যু-ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা
বেইলি রোড ট্র্যাজেডি
[তারা তিনজন। আগুনের লেলিহান শিখা যখন বেইলি রোডের বহুতল ভবনটিতে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তারা ওই ভবনেই ছিলেন। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। চিকিৎসাধীন এ তিনজনের সঙ্গে গতকাল শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে কথা বলেছে আমাদের সময়। তাদের জবানিতে উঠে এসেছে বিভীষিকাময় সেই রাতের মৃত্যু-ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশিকুল হক রিফাত]
‘একেকটি সেকেন্ড মনে হচ্ছিল একেকটি ঘণ্টা! আমার দশ মাস বয়সী একটি মেয়ে আছে। শুধু বাবা বলে ডাকতে পারে। ওই ভয়াল সময়টাতে শুধু মেয়ের মুখটি আমার মনে ভেসে উঠছিল। রুদ্ধ কান্নায় বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছিল’- এইটুকু বলে থামেন ফিরোজ আল মামুন ফয়সাল (৩৬)। চোখেমুখে তার তিক্ত-অভিজ্ঞতার ছাপ তখনো লেগে আছে। গত বৃহস্পতিবার বেইলি রোডের সাততলা ভবন গ্রিন কোজি কটেজের তৃতীয় তলায় এলিয়েনের শোরুমে বাবার জন্য পাঞ্জাবি কিনতে গিয়েছিলেন এই ব্যবসায়ী। পাঞ্জাবি বাছাইয়ের পর যখন দাম দিতে যাচ্ছিলেন, তখনই মানুষজনের চিৎকার আর হুড়োহুড়ির শব্দ কানে আসে তার। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই টের পেয়ে যান, ভবনটিতে আগুন লেগেছে। তাড়াহুড়ো করে তৃতীয় তলা থেকে নামার জন্য সিঁড়ির পথ ধরেন। কিন্তু নিচে এসে দেখতে পান ভবনের মূল ফটক বন্ধ। আবার ফিরে যান ওই শোরুমে। এর মধ্যেই বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। সিঁড়িতে রাখা সিলিন্ডারগুলো বিস্ফোরিত হচ্ছে! আতঙ্কে তার পুরো গা হিম হয়ে আসে। এর মধ্যেই ঝুপ করে নেমে এসেছে অন্ধকার! এলিয়েনের শোরুমও ক্রমেই বিষাক্ত ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। ফয়সাল বলেন, আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না। প্রাণ বাঁচাতে ওই শোরুমের মেঝেতে উপুড় হয়ে নাক ঠেকিয়ে শ্বাস নিচ্ছিলাম। কতক্ষণ এভাবে নিজেকে রক্ষা করা যাবে? প্রতিটি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল- এটিই বুঝি শেষ নিঃশ্বাস!
আর শ্বাস নিতে পারব না। পৃথিবীর সব মায়া কাটিয়ে এখনই বুঝি চলে যেতে হচ্ছে আমাকে। মৃত্যুর প্রহর গুনতে গুনতে উপুড় হওয়া অবস্থাতেই কেটে যায় প্রায় দেড় ঘণ্টা! এরপর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আমাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে। ভবন থেকে যখন আমাকে ক্রেনে তোলা হয়, মনে হলো নতুন জীবন পেলাম। দ্বিতীয় জীবন।
মেহেদী হাসান (২২) সেদিন ওই ভবনের রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন তার স্ত্রী এবং চীন থেকে আসা এক বন্ধুকে নিয়ে। তিনি বলেন, আমরা রেস্টুরেন্টে বসে খাবারের অর্ডার দেওয়ার পরপরই বাইরে থেকে ভেসে আসা অস্বাভাবিক শব্দ- কোলাহলে টের পাই যে, আগুন লেগেছে। হুট করেই তিনজন দাঁড়িয়ে পড়ি, রেস্টুরেন্ট থেকে তড়িঘড়ি বের হই। এরপর সিঁড়ি দিয়ে ছাদে যাওয়ার চেষ্টা করি। দেখি উপরতলায়ও আগুন! তিনজনই ইউটার্ন। তড়তড় করে নিচে নামছি। কিন্তু একেবারে নিচে নেমে দেখি, গেট বন্ধ! আবার ওপরের দিকে উঠতে শুরু করি। তৃতীয় তলায় দেখি, একটি শোরুমের (এলিয়েন) দরজা খোলা! কিছু না ভেবে সেই দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ি। নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে ভেতরের দিকে যেতে যেতে একেবারে ওয়াশরুমে পৌঁছে যাই। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে শ্বাসকষ্ট। ওই শোরুমের কিছু পাঞ্জাবি পায়জামার স্টক দেখতে পেয়ে সেগুলো নিয়ে আসি। সেগুলো পানিতে ভিজিয়ে ওয়াশরুমটা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি। এর মধ্যেই বড় ভাইকে ফোন দিই। মনে হচ্ছিল, জীবনের শেষ মুহূর্ত উপস্থিত! এভাবেই কেটে যায় প্রায় দুই ঘণ্টা! তখন মনে হচ্ছিল যেন হাজার বছর!
এরপর গল্প থেমে যায় মেহেদী হাসানের। প্রশ্ন নিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতেই বলেন, মৃত্যুর বিভীষিকাময় সেই গল্প আর মনে করতে চাই না, ভয়ে শিউরে ওঠি!
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
প্রায় দুই ঘণ্টা পর উদ্ধার করা হয় তাদের।
২৯ ফেব্রুয়ারি আসে চার বছর পর একবার। সেই হিসাবে একটি বিশেষ দিনই বটে। তাই এই দিনটি উদযাপনে চার বন্ধুকে নিয়ে ওই ভবনের রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাদ মাহমুদ (২৩)।
আগুন লাগার পর বিদ্যুৎ চলে যায়। পুরো বিষয়টি বুঝতে পেরে আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করি। তখন দেখি, নিচের লোকজন বরং ওপরের দিকে উঠে আসছে।- ভয়াল সেই রাতের স্মৃতি এভাবেই তুলে ধরেন সাদ মাহমুদ। বলেন, আগুন লাগার খবরে তখন সবাই আতঙ্কিত। দিগি¦দিক ছোটাছুটি করছে। এর মধ্যে ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে শ্বাস নেওয়াই দায়! একপর্যায়ে সিঁড়ি বেয়ে ভবনের ওপরের দিকে উঠতে থাকি, যতটা ওপরে ওঠা যায়। ছয়তলায় গিয়ে দেখতে পাই, একটা খোলা গেটের মতো, সেদিকেই এগিয়ে যাই। এর মধ্যে পেছনে তাকিয়ে ঠাহর করতে পারি, আমার বন্ধুরা কেউ-ই নেই। হুড়োহুড়িতে কে কোথায় হারিয়ে গেছে। সেখানে আমি আরও ৬০-৭০ জনকে দেখতে পাই। প্রথমে অল্প অল্প ধোঁয়া আসছিল। পরে ধোঁয়া বাড়তে থাকে। প্রায় আধা ঘণ্টা সেখানে ছিলাম। কীভাবে শ্বাস নিয়েছি, সেটা ভাবতেও এখন গায়ে কাঁটা দেয়! ছয়-সাতজন ভবনের কাচ ভেঙে ছয়তলা থেকেই লাফিয়ে পড়েছে। তাদের কী হয়েছে, জানি না! একপর্যায়ে ওই রেস্টুরেন্টের মূল কক্ষ ধোঁয়ার আচ্ছন্ন হয়ে গেলে আমি কিচেনে চলে যাই। সেখানে গিয়ে মুখে বারবার পানির ঝাপটা দিতে থাকি। মুখে রুমাল চেপে শ্বাস নিই। এরই মধ্যে আশপাশে শুরু হয়ে যায় কান্নাকাটি। এর মধ্যে ভেসে আসছিল ফায়ার সার্ভিসের লোকদের হ্যান্ডমাইকের নির্দেশনা। তারা সম্ভব হলে ছাদে চলে যেতে বলছিল। কিন্তু আমি যে কিচেন থেকে বের হব, ঘন ধোঁয়ার কারণে সেটা সম্ভব ছিল না। সবকিছু বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। এর ৫-৬ মিনিট পর আমাদের ফ্লোরে ফায়ার সার্ভিসের ক্রেন আসে। কাচ ভেঙে সেই ক্রেনে পা রাখার সময় মনে হচ্ছিল, নতুন জীবনে পদার্পণ করলাম।
চার বন্ধুর কী খবর? সাদ মাহমুদ বলেন, জুনায়েদ হক ও নাজমুল ইসলাম নামের দুই বন্ধু আর নেই। ভয়াবহ আগুন চিরতরে তাদের কেড়ে নিয়েছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
এ কথা বলার সময় কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে তার। হাসপাতালের বেডে শুয়েই অশ্রু মোছেন সদ্য প্রিয় বন্ধুহারা ভাঙামনের এই তরুণ।
বেইলি রোডে গত বৃহস্পতিবারের অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৫ জনকে।
প্রতিটি সেকেন্ড মনে হচ্ছিল এক একটি ঘণ্টা
মামুন ফয়সাল
মনে হচ্ছিল জীবনের শেষ মুহূর্ত উপস্থিত
মেহেদী হাসান
সঙ্গী দুই বন্ধু আর নেই
সাদ মাহমুদ