‘কোন টিকিট নিয়ে চলে গেলা বাবা’
একই লাশ দাবি করছে মিনহাজ ও নাজমুলের পরিবার
রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে এক বন্ধুর সঙ্গে খেতে যাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন সফটওয়্যার প্রকৌশলী কেএম মিনহাজ। একই ভবনে ছিলেন ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলাম। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকা একটি লাশকে এই দুজনের বলে দাবি করছে উভয়ের পরিবার। তবে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করে মরদেহ স্বজনদের হস্তান্তর করা হবে। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে রাজধানীর বাসাবো এলাকায় বড় ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন মিনহাজ। শুক্রবার রাতে বেইলি রোডের ওই ভবনে অগ্নিকাণ্ড শুরু হলে তার বন্ধু ভবনের দোতলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে বেঁচে যান। তবে নামতে পারেননি মিনহাজ। ঘটনার রাতে নানা জায়গায় খোঁজ নিয়েও মিনহাজের সন্ধান পাননি স্বজনরা। পরে জানতে পারেন আগুন লাগা ভবনটিতে আটকে পড়েছেন মিনহাজ। চাঁদপুরে গ্রামের বাড়িতে মিনহাজের মা আমেনা বেগমকে জানানো হয় তার ছেলে চিকিৎসাধীন। এ কথা শুনে স্বজনদের সঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসেন মা। সিআইডির ডিএনএ ইউনিট যখন ডিএনএ টেস্টের জন্য আমেনার নমুনা সংগ্রহ করছিলেন তখন তিনি বুঝতে পারেন তার সন্তান আর বেঁচে নেই।
বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন আমেনা। বলছিলেন, ‘বাবা তুমি আমাকে নিয়ে হজে যাওয়ার কথা বলেছিলে, এখন একা একা এ কোন টিকিট নিয়ে চলে গেলা?’ এ সময় বসে থাকা বেঞ্চ থেকে বারবার মেঝেতে পড়ে ছেলের জন্য আহাজারি করছিলেন তিনি। পাশে থাকা স্বজনরা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। পাশেই বড় ছেলের গলা জড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন মিনহাজের বাবা অলি উল্লাহ। মিনহাজের বড় ভাই আমিনুল ইসলামকে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে ছোট ভাইয়ের লাশ বুঝে পেতে যোগাযোগ করছিলেন।
একই ঘটনায় মারা যান বেসরকারি ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলাম। নাজমুলদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের সদরে, তার বাবা নজরুল ইসলাম ঢাকায় ব্যবসা করেন। পরিবারের সঙ্গে বনশ্রীতে বসবাস করতেন তিনি। খোঁজাখুঁজির পরও ছেলের সন্ধান পাচ্ছেন না বাবা নজরুল ইসলাম। বন্ধুদের সঙ্গে ওই ভবনের একটি রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন নাজমুল। তারাই খবর দিয়েছেন নাজমুল ভবনের ভেতরে আটকে পড়েন।
ছেলের মৃত্যু অনেকটা নিশ্চিত জেনে হাসপাতালে ছুটে এসে নাজমুলের বাবা নজরুল ইসলাম ও মা হাসিনা বেগম বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বাবা নজরুল বলছিলেন, ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল, পড়াশোনা শেষে চাকরিতে যোগ দেবে, সবকিছু শেষ হয়ে গেল।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
হাসপাতালের মর্গের একটি মরদেহ নাজমুল ও মিনহাজের বলে দুই পরিবারই দাবি করেন। এ অবস্থায় ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে মরদেহ শনাক্ত করতে তাদের বাবা-মায়েদের নমুনা নিয়েছে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট। সিআইডির ডিএনএ বিশেষজ্ঞ আশরাফুল আলম জানান, মরদেহ পেতে দুই পরিবারকে ডিএনএ রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
নাজমুলের বাবা নজরুল ইসলাম বলেন, মর্গে কয়েকটি লাশ দেখে একটি তার ছেলের বলে মনে হয়েছে। একই কথা বলেছেন নাজমুলের মামা আনোয়ার হোসেন গাজী। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আমি মর্গের রুমে গিয়ে সব লাশ দেখেছি। এত বেশি পুড়ে ছাই হয়েছে যে, খালি চোখে দেখে বোঝা যাচ্ছে না। তবে একটি বডি দেখে নাজমুলের মনে হচ্ছে। বডি স্ট্রাকচার মনে হচ্ছে লাশটি নাজমুলের।
এদিকে হাসপাতালে আসা মিনহাজের দূর সম্পর্কের মামা আবু রায়হান শরীফের সঙ্গে কথা হয়। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আমরা যে লাশটি মিনহাজের বলে দাবি করছি, একই লাশ নাজমুলের বলে দাবি করছেন তাদের পরিবারও। এ বিষয়ে হাসপাতালেই দুই পরিবারের সদস্য একে-অপরের সঙ্গে কথা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
এদিকে আলিমে ভর্তি হয়েও আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে না পেরে ঢাকায় চলে আসেন পাবনার ফরিদপুরের ধানুয়াঘাটা আবু তালেবের ছেলে সাগর হোসেন। ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনের নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন তিনি। হাসপাতালের মর্গে ছেলের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন আবু তালেব। তিনি জানান, সাগরের ইচ্ছা ছিল দেশের বাইরে যাবে। ছেলের বিদেশে যাওয়ার টাকা জোগার করতে এদিক-সেদিক কাজ করে কিছু টাকাও জমিয়েছেন। বাকি টাকার জোগান দিতে কয়েক মাস আগে ঢাকায় চাকরি নেন সাগর।
গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে আগুন লাগে। প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় রাতে ১১টা ৫০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪৬ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ৪৩টি মরদেহ শনাক্ত করা হয় এবং তাদের মধ্যে ৩০ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ১২ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।