ঋণখেলাপি দুই ভাইয়ের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণায় তোলপাড়
পটুয়াখালী পৌরসভা নির্বাচনের মেয়র প্রার্থী দুই ভাই ঋণখেলাপি হওয়ার পরও তাদের মনোনয়নপত্র বৈধতা পেল। গত মঙ্গলবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আপিল শুনানিতে বর্তমান মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ এবং তার ভাই আবুল কালাম আজাদের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেন জেলা প্রশাসক নূর কুতুবুল আলম।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ঋণখেলাপির দায়ে আবুল কালাম আজাদ এবং ঋণের জামিনদার তার ভাই বর্তমান মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদের মনোনয়ন বাতিল চেয়ে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বরাবর চিঠি দেয় পদ্মা ব্যাংক। ওই দিনই মনোনয়নপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আপিল করেন অপর প্রার্থী ডা. শফিকুল ইসলাম। কিন্তু ঋণখেলাপি ও হলফনামায় তথ্য গোপনের গুরুতর এ অভিযোগের পরও আপিলে মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ আপিলকারীর আইনজীবীরা। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে লড়বেন বলে জানান আপিলকারীর আইনজীবী শওকত মৃধা।
আবুল কালাম আজাদের হলফনামায় তিনি পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড পটুয়াখালী শাখায় ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু গত ১৫ ফেব্রুয়ারি খেলাপি ঋণের ২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা উল্লেখ করে পটুয়াখালী পদ্মা ব্যাংক শাখা ব্যবস্থাপক একটি চিঠি দেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে। সেই হিসাবে ব্যাংকের সঙ্গে হলফনামায় ১৫ কোটির টাকার বিশাল ব্যবধান।
ঋণখেলাপি এবং হলফনামায় তথ্য গোপনের পরও নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা তার মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করায় তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তার পক্ষপাতমূলক আচরণে সংক্ষুব্ধ হয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আপিল মোকদ্দমা দাখিল করেন অপর মেয়র প্রার্থী ডা. মো. শফিকুল ইসলাম। পরে ১৮ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেন আবুল কালাম আজাদ। আবুল কালাম আজাদ ও মহিউদ্দিনের পক্ষে আপিল শুনানি করেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন।
স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) নির্বাচন আইন অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তারিখে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গৃহীত কোনো ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় অনাদায়ী রাখলে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য হবেন না। সেই হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর খেলাপিঋণের টাকা পরিশোধ করলেও প্রার্থী হিসেবে যোগ্য হওয়ার কথা নয়।
আইনে আরও বলা হয়েছে প্রার্থী বা তার পরিবারের কোনো সদস্য সংশ্লিষ্ট পৌরসভার কার্য সম্পাদনে বা মালামাল সরবরাহের জন্য ঠিকাদার নিযুক্ত হন বা এর জন্য নিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হন বা পৌরসভার কোনো বিষয়ে তার কোনো প্রকার আর্থিক স্বার্থ থাকে, সেক্ষেত্রে তার প্রার্থিতা যোগ্য হবে না। অথচ মেয়র প্রার্থী আবুল কালাম আজাদের মালিকানাধীন মেসার্স আবুল কালাম আজাদ পৌরসভার বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি করছে। সেই হিসেবে আইন অনুযায়ী আবুল কালাম আজাদ এবং তার ভাই মহিউদ্দিন আহমেদ আহমেদ প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ, তার বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ ও স্ত্রী মার্জিয়া আক্তার মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। একই পরিবারের তিনজন একসঙ্গে মনোনয়নপত্র দাখিল করায় সবার সন্দেহ তৈরি হয়। এরপর বেরিয়ে আসে ঋণ খেলাপির তথ্য গোপনের বিষয়টি।
এ বিষয়ে মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদের বড় ভাই আবুল কালাম আযাদ বলেন, ‘আমি ঋণখেলাপি নই। ঋণের কিস্তি বকেয়া ছিল এটা ঠিক। এটা নিয়ে কথা ওঠায় ব্যাংকের সব টাকা দিয়ে দিয়েছি। ব্যাংক টাকা পেয়েছে মর্মে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছে। মহিউদ্দিনতো জামিনদার। এখন আইনে যা আছে তাই হবে।’
এ বিষয়ে সাবেক মেয়র ডা. মো. শফিকুল ইসলাম জানান,‘ আমি সংক্ষুব্ধ হয়ে জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু অবৈধ কালো টাকার বিনিময়ে ঋণখেলাপিরা ঢাকা থেকে ব্যারিস্টার সাইদুল হক সুমনকে আইনজীবী হিসেবে এনে শুনানিতে অংশগ্রহণ করান। আপীল কর্তৃপক্ষ আমাদের পক্ষের সকল কথা না শুনেই মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেন। আমরা এই সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হয়েছি এবং আমরা উচ্চ আদালতে যাব।’
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) পটুয়াখালী জেলা কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মানস কান্তি দত্ত বলেন, ‘ঋণেখলাপি কোনো ব্যক্তির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ রাষ্ট্র দেয়নি। পটুয়াখালীর ক্ষেত্রে কি হয়েছে সেটা এখনো পরিষ্কার না। আমরা চাই আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে কালোটাকা, পেশীশক্তির প্রভাবমুক্ত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন।’
সাবেক সিইসি বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘মিথ্যা বা ভুল তথ্য দিয়ে এফিডেভিট দিলে তার প্রার্থিতা বাতিল হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি যদি দায়িত্বে থাকতাম তাহলে রিটার্নিং অফিসারকে বলতাম, ওটা (মনোনয়ন) বাদ। আর ঋণগ্রহীতার জামিনদারও যদি প্রার্থী হয়, তাহলে তারও মনোনয়ন বাতিল হবে। এদের দুইজনের মনোনয়ন বৈধ হবার কোনো সুযোগই নাই।’