বড় অঙ্কের নগদ লেনদেনে বাড়ছে অর্থপাচারের ঝুঁকি

জিয়াদুল ইসলাম
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বড় অঙ্কের নগদ লেনদেনে বাড়ছে অর্থপাচারের ঝুঁকি

দেশের আর্থিক খাতে বড় অংকের লেনদেন বাড়ার পাশাপাশি সন্দেহজনক লেনদেনও বেড়েছে। শুধু এক বছরেই সন্দেহজনক লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। এ অবস্থায় বড় অঙ্কের নগদ লেনদেনের কারণে অর্থপাচারের ঝুঁকিও বাড়ছে। কারণ নগদ লেনদেনের অর্থের প্রকৃত উৎস জানা সম্ভব না হওয়ায় এ প্রবণতা বাড়ছে। দেশের কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক প্রতিবেদন সূত্রে এমন আশঙ্কার কথা জানা গেছে।

বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সর্বশেষ গত অর্থবছরে সারাদেশে ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে বড় অঙ্কের নগদ লেনদেন (সিটিআর) বেড়েছে সাড়ে ৮ শতাংশেরও বেশি। প্রতিবছরই এ ধরনের লেনদেন বাড়ছে। এর মধ্যে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এই লেনদেন বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক, প্রায় ২০ শতাংশ। সব মিলে গত অর্থবছরে বড় অঙ্কের নগদ লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এই লেনদেশের ৮০ শতাংশই হয়েছে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে। এ সময়ে ৯০ হাজার সিটিআরের বিপরীতে ২ লক্ষাধিক কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়েছে, যার প্রত্যেকটি ছিল এক কোটি টাকার ওপরে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন বিএফআইইউ প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস।

কোনো নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে দৈনিক ১০ লাখ টাকার ওপরে যে কোনো ধরনের লেনদেন হলে তা নগদ লেনদেন প্রতিবেদন (সিটিআর) হিসেবে বিএফআইইউতে রিপোর্ট করতে হয়। পাশাপাশি অর্থপাচার, জঙ্গি বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন, ঘুষ-দুর্নীতি বা বেআইনি কোনো লেনদেনের বিষয়ে সন্দেহ হলে ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের সব ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিএফআইইউর কাছে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) ও সন্দেহজনক কার্যক্রম প্রতিবেদন (এসএআর) পাঠাতে হয়। পরে বিএফআইইউ এসব লেনদেন পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে পাঠায়।

প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক হিসাবে বড় অঙ্কের নগদ লেনদেন মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে মনে করছে বিএফআইইউ। কারণ নগদে জমা ও উত্তোলন হওয়া অর্থের প্রকৃত উৎস সম্পর্কে জানা সম্ভব হয় না। ফলে সন্দেহজনক ও নগদ লেনদেনের প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি বাড়ছে। এটা নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি বিএফআইইউ থেকে ব্যাংকগুলোকে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে নগদ লেনদেন পর্যালোচনার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে নগদ লেনদেন নিরুৎসাহিত করতে চেকের ব্যবহার ও ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

বড় অঙ্কের সিটিআরের সঙ্গে মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকি জড়িত থাকায় প্রতিবেদনে নগদ লেনদেন নিরুৎসাহিতে তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো- মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকি হ্রাসে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নগদ লেনদেন নিরুৎসাহিতের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে সংঘটিত বড় অঙ্কের লেনদেন কমিয়ে আনতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে হওয়া নগদ লেনদেন কমিয়ে আনতে শক্তশালী তদারকির ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

বিএফআইইউ প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, সংস্থাটি সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্যগুলো পর্যালোচনা করে দেখছে। কোনো লেনদেনে অপরাধের উপাদান থাকলে সেগুলোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে তিনি বলেন, এসটিআর ও এসএআর বৃদ্ধি মানেই আর্থিক খাতে সন্দেহজনক কার্যক্রম বেড়েছে তেমন নয়। বরং রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, বিএফআইইউর তৎপরতা ও কঠোর অবস্থান এবং অপরাধের ধরন পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের রিপোর্ট বেড়েছে।

বড় অঙ্কের লেনদেনের (সিটিআর) ধরন : ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে গত অর্থবছরে ১০ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকার কম সিটিআর হয়েছে ৬২ লাখ ১০ হাজারটি। এসব সিটিআরের বিপরীতে নগদ লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৬১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা, যা মোট সিটিআর লেনদেনের ৩৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকার কম সিটিআর রিপোর্ট হয়েছে ১১ লাখ ৫০ হাজারটি, যার বিপরীতে লেনদেনের পরিমাণ ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা বা ১৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার কম সিটিআর হয়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজারটি, যার বিপরীতে লেনদেনের পরিমাণ ২ লাখ ৪৬ হাজার ২০৪ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আর এক কোটি টাকার ওপরে সিটিআর হয়েছে ৯০ হাজারটি। এর বিপরীতে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ।

সীমান্তবর্তী এলাকায় নগদ লেনদেন বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক : ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে সারাদেশে গত অর্থবছরে সার্বিক নগদ লেনদেন হয়েছে ২২ লাখ ৮৬ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। এটি আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি। তবে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় আলোচ্য অর্থবছরে নগদ লেনদেন বৃদ্ধির হার ছিল ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত অর্থবছরে সীমান্তবর্তী জেলায় ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৬৭ কোটি টাকা নগদ লেনদেন হয়েছে। এর ঠিক আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে এ জেলাগুলোয় নগদ লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ২৩ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। জামালপুর ছাড়া দেশের সীমান্তবর্তী সব জেলায় নগদ লেনদেন বেড়েছে। বিশেষ করে কুমিল্লা, যশোর, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ জেলায় এ ধরনের লেনদেন হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সীমান্তবর্তী অন্যান্য জেলার মধ্যে রয়েছে-কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, হবিগঞ্জ, শেরপুর, নওগাঁ, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও চুয়াডাঙ্গা। সীমান্তবর্তী জেলায় নগদ লেনদেন বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সীমান্তকেন্দ্রিক অপরাধকে দায়ী করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে উদ্বেগের জায়গাগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে আন্তঃসীমান্ত অপরাধ। জাতীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। সীমান্ত এলাকাগুলো এখন মাদক ও মানবপাচার, পণ্য ও অস্ত্র চোরাচালানের মতো অপরাধগুলোর উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এ কারণে এসব এলাকায় অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের ঝুঁঁকিও বেশি।

এদিকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের সমসাময়িক ঝুঁকি মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণবিষয়ক বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তা ও উপপ্রধান কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা করে বিএফআইইউ। ওই সভায় কঠোর বার্তা দিয়ে বলা হয়, ব্যাংক কর্মকর্তাদের সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সংবেদনশীল অঞ্চলসমূহে কার্যরত ব্যাংকের শাখাসমূহের গ্রাহকদের লেনদেন পর্যালোচনা জোরদার করতে হবে।