পাঁচ বছরে ১১শর বেশি ঋণ অনিয়ম-জালিয়াতি
ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা থামছে না। উল্টো দিন দিন বাড়ছে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৫২০টি ঋণ অনিয়ম এবং জালিয়াতির তথ্য পেয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আগের অর্থবছরের চেয়ে এটি সাড়ে ৫২ শতাংশ বেশি। সব মিলিয়ে গত পাঁচ বছরে সন্দেহজনক হিসেবে ১ হাজার ১০০টিও বেশি ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির তথ্য বিএফআইইউর কাছে এসেছে। শুধু তাই নয়, এই সময়ে আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেনের ঘটনাও (এসটিআর) ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গত ৫ বছরের ব্যবধানে সন্দেহজনক লেনদেনের ঘটনা বেড়েছে প্রায় ২৯৫ শতাংশ। এর মধ্যে গত অর্থবছরেই বেড়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। এর বাইরে বড় অঙ্কের লেনদেনের ঘটনা ও সীমান্তবর্তী জেলায় নগদ লেনদেন বাড়ার তথ্যও মিলেছে।
বিএফআইইউর ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তবে এসব ঋণ ও লেনদেনের ঘটনায় জড়িত অর্থের পরিমাণ কত, সেটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
নিয়মানুযায়ী, সন্দেহজনক লেনদেন হলে তা দেশের ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শেয়ারবাজারে লেনদেনে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান (সিএমআই), বীমা কোম্পানি, মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন রিপোর্টিং এজেন্সিকে বিএফআইইউর কাছে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) এবং সন্দেহজনক কার্যক্রম প্রতিবেদন (এসএআর) পাঠাতে হয়। একইভাবে ১০ লাখ টাকার ওপরের লেনদেনও রিপোর্ট করতে হয়। পরে বিএফআইইউ বিশ্লেষণ ও তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে প্রতিবেদন পাঠায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সন্দেহজনক ঋণ ও লেনদেনের ঘটনার সঙ্গে অর্থপাচারের বিষয় জড়িত। ফলে এসব ঋণ অনিয়ম ও লেনদেনের আড়ালে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারও হয়েছে। এ ছাড়া একই কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খেলাপি ঋণও ব্যাপক হারে বেড়েছে। তবে প্রতিবেদনে বিষয়টিতে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে বিএফআইইউপ্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, এসটিআর বৃদ্ধি মানেই আর্থিক খাতে সন্দেহজনক কার্যক্রম বেড়েছে তেমন না। বরং রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, বিএফআইইউর তৎপরতা ও কঠোর অবস্থান এবং অপরাধের ধরন পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের রিপোর্ট বেড়েছে। তিনি জানান, গত বছর দেশে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে ১ হাজার ৭১টি তথ্যবিনিময় হয়েছে। এর মধ্যে সিআইডিসহ পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা নিয়েছে ৬৮০টি। বাকি তথ্য নিয়েছে দুদক, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা।
ঋণ ও জালিয়াতি : বিএফআইইউর প্রতিবেদনে এবারই প্রথম সন্দেহজনক ঋণ ও কার্যক্রমের তথ্য দেওয়া হয়েছে। এতে ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ এই ৫ বছরের তথ্য দেওয়া আছে। এতে দেখা যায়, প্রথম তিন অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রমের রিপোর্ট জমার পরিমাণ ছিল কম। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫৯টি, ২০১৯-২০ অর্থববছরে ৯৪টি ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৮টি ছিল। তবে এর পরের ২০২১-২২ অর্থবছরে সেটি একলাফে ৩৪১টিতে পৌঁছায়। আর গত অর্থবছরে সেটি আরও বেড়ে হয়েছে ৫২০টি। সব মিলিয়ে গত ৫ অর্থবছরে ১ হাজার ১১২টি ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনার রিপোর্ট করা হয়েছে বিএফআইইউতে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
ছয় কারণ : এ ধরনের ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা বিশ্লেষণে ৬টিরও বেশি কারণের কথা জানতে পেরেছে বিএফআইইউ, যা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এগুলো হলো- জাল নথি বা ভুয়া কাগজপত্রের ব্যবহার এবং একই সম্পত্তি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বন্ধক দিয়ে ঋণগ্রহণ। অনেক সময় মেয়াদপূর্তির আগে ঋণ নিষ্পত্তি করা। এ ক্ষেত্রে নগদ আমানত বা বন্ধকি সম্পত্তি দিয়েও তা সমন্বয় দেখানো হয়েছে। ঋণের কিস্তি পরিশোধের সঙ্গে ব্যবসার প্রকৃতির মিল পাওয়া যায় না। পর্যাপ্ত নগদ প্রবাহ থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ ফেরত না দেওয়া, ঋণখেলাপির দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া বা ঋণ সমন্বয় না করেই ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া। এক উদ্দেশ্যে ঋণ নিয়ে আরেক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা। এ ক্ষেত্রে বিপুল নগদ উত্তোলন বা ঋণ সম্পর্কিত বাইরের লোকের কাছে তহবিল স্থানান্তর করা। এক ব্যাংক ঋণ পরিশোধে নিয়মিত থাকলেও আরেক ব্যাংক থেকে অনিয়ম করে ঋণ নেওয়া। এ ছাড়া গণমাধ্যমে আসা ঋণ অনিয়মের ঘটনার তথ্যও বিএফআইইউতে এসেছে।
এদিকে দুই মাস আগে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘গত ১৫ বছরে অন্তত ২৪টি বড় ঋণ কেলেঙ্কারির’ মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত থেকে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর মানে আর্থিক খাতে ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা দিন দিন বাড়ছেই।
সন্দেহজনক লেনদেন : গত অর্থবছরে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন রিপোর্টিং এজেন্সি বিএফআইইউতে মোট ১৪ হাজার ১০৬টি লেনদেন ও কার্যক্রম সন্দেহজনক মনে করে রিপোর্ট করা হয়েছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৮ হাজার ৫৭১টি। ফলে এক বছরের ব্যবধানে সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রমের রিপোর্ট বেড়েছে ৫ হাজার ৫৭১টি বা ৬৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এর মধ্যে এসটিআর হিসাবে ৯ হাজার ৭৬৯টি এবং এসএআর হিসাবে ৪ হাজার ৩৩৭টি সন্দেহজনক রিপোর্ট হয়েছে।
এ সময়ে ব্যাংকিং খাত থেকে সবচেয়ে বেশি ১২ হাজার ৮০৯টি এসটিআর ও এসএআরের রিপোর্ট বিএফআইইউতে এসেছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল মাত্র ৭ হাজার ৯৯৯টি। ফলে ব্যাংকিং খাতে এসটিআর ও এসএআর এক বছরে বেড়েছে ৪ হাজার ৮১০টি বা ৬০ দশমিক ১৩ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯০০ রিপোর্ট জমা দিয়েছে এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪৫৭টি। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠাগুলো রিপোর্ট জমা দেয় ১২১টি, যা আগের অর্থবছর ছিল ১০৬টি। সিএমআই থেকে এসেছে মাত্র ৫টি, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪টি। অন্যান্য থেকে এসেছে ২৭১টি, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫টি।
থেমে নেই অর্থপাচার : সংবাদ সম্মেলনে দেশ থেকে অর্থপাচার হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। তিনি বলেন, প্রতিবছর দেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থপাচার হয়, তার ৮০ শতাংশই বাণিজ্যভিত্তিক তথা আমদানি-রপ্তানির আড়ালে। আর আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম মূলত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেই হয়। কাজেই ব্যাংক যদি এটি বন্ধে সহযোগিতা না করে, তা হলে এটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তা ছাড়া একবার অর্থপাচার হয়ে গেলে তা ফেরত আনা কঠিন।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
এক প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিশ্বাস জানান, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা ও সহযোগিতার জন্য ১০ দেশের সঙ্গে এমওইউ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএফআইইউর তথ্যের ভিত্তিতে অর্থপাচারের মামলা হয়েছে ৫৯টি। এর মধ্যে দুদক মামলা করেছে ৪৭টি, সিআইডি ১০টি এবং এনবিআরের বিশেষ সেল ২টি। এগুলো এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
বড় অঙ্কের লেনদেনেও লাফ : সন্দেহজনক লেনদেন বৃদ্ধির পাশাপাশি গত অর্থবছরে বড় অঙ্কের নগদ লেনদেনের তথ্য প্রেরণ (সিটিআর) বেড়েছে। এই সময়ে ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৮০ হাজারটি সিটিআর লেনদেন হয়েছে। এসব সিটিআরের মাধ্যমে ২২ লাখ ৮৫ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা জমা ও উত্তোলন হয়েছে। আগের অর্থবছর ৩ কোটি ৬৮ লাখ ৯০ হাজারটি সিটিআরের বিপরীতে ২১ লাখ ১১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো জমা ও উত্তোলন হয়।