পুলিশ হেফাজতে বডিবিল্ডারের মৃত্যু: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মানবাধিকার কমিশনের চিঠি
পুলিশ হেফাজতে বডিবিল্ডার ফারুকের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পর প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে চিঠি দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
আজ মঙ্গলবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপপরিচালক ফারহানা সাঈদের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে চিঠি দেওয়া বিষয়টি জানিয়েছে কমিশন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ৮ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘পুলিশ হেফাজতে বডিবিল্ডার ফারুকের মৃত্যু’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে জানিয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। ঘটনাটি সত্য হয়ে থাকলে তা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে কমিশন মনে করে। হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।’
এ অবস্থায় এ ঘটনার বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত ও প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে কমিশনের কাছে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে বলা হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
রাজধানীর বংশালে কায়েতটুলী পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে বডিবিল্ডার ফারুক হোসেনের মৃত্যু হয়েছে এমন অভিযোগে বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) ৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ফারুকের স্ত্রী ইমা আক্তার হ্যাপী গত ৩০ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামানের আদালতে মামলার আবেদন করেন।
আদালত গতকাল বুধবার পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে (ডিবি) নির্দেশ দিয়েছেন, মামলাটি তদন্ত করে আগামী ২৮ মার্চ প্রতিবেদন জমা দিতে। সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) তাপস কুমার পাল এ তথ্য জানান।
মামলার আসামিরা হলেন বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাইনুল ইসলাম, একই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইমদাদুল হক (কায়েতটুলী পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক), আবু সালেহ, মাসুদ রানা ও বুলবুল আহমেদ।
জানা যায়, গত ১৪ জানুয়ারি রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অচেতন অবস্থায় বডিবিল্ডার ফারুককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ফারুক সিটি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শোয়েবের দেহরক্ষী ছিলেন। নিহতের স্ত্রী ইমা আক্তার হ্যাপীর অভিযোগ, ঘুষ না দেওয়ায় ফারুককে রাস্তা থেকে ধরে এনে মাদকের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে কায়েতটুলী পুলিশ ফাঁড়ির কয়েকজন পুলিশ সদস্য। পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনও চালানো হয় ফারুকের ওপর। এ কারণেই অসুস্থ হয়ে ফারুকের মৃত্যু হয়।
এ বিষয়ে গত ১৮ জানুয়ারি ‘পুলিশ নির্যাতন করে আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয় দৈনিক আমাদের সময়ে। প্রতিবেদন প্রকাশের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (কোতোয়ালি জোন) মো. বদরুল হাসানকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে লালবাগ বিভাগের ডিসি দপ্তর।
পুলিশি নির্যাতনে ফারুক হোসেনের মৃত্যুর অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গত ২৩ জানুয়ারি ভুক্তভোগীর স্ত্রীর বক্তব্য নিয়েছে তদন্ত কমিটি। ফারুকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মাদক মামলার সাক্ষী পুলিশের সোর্স মো. সুজন ও পথচারী মো. সাগরের বক্তব্যও নেয় কমিটি।
লিখিত বক্তব্যে ফারুকের স্ত্রী অভিযোগ করেন, তার স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে এক লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন কায়েতটুলী পুলিশ ফাঁড়ির কয়েক সদস্য। এই টাকা না দেওয়ায় ফারুক হোসেনকে মাদকের মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়।
অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে কায়েতটুলী পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো. ইমদাদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ‘মাদকসহ গ্রেপ্তারের পর আইন মেনেই ফারুকের নামে মামলা হয়েছে। তাকে ছেড়ে দিতে পুলিশ টাকা দাবি করেছে বলে যে অভিযোগ, সেটা ভিত্তিহীন। ফারুক হোসেনকে একটি থাপ্পড়ও দেওয়া হয়নি। তদন্ত কমিটির কাছে আমি আমার বক্তব্য পেশ করেছি। তদন্তেই প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।’
আদালতে মামলার আর্জিতে ইমা আক্তার হ্যাপী উল্লেখ করেন, গত ১২ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৯টায় ফারুক হোসেন লালবাগের খাজা দেওয়ান সিং লেনের বাসা থেকে ব্যক্তিগত কাজে বের হন। এর একঘণ্টা পর ফারুক স্ত্রীকে ফোন করে জানান, তাকে সন্দেহজনকভাবে কায়েতটুলী ফাঁড়ির পুলিশ গ্রেপ্তার করে আটকে রেখে নির্যাতন করছে। দুই বছরের সন্তান কোলে হ্যাপী সেখানে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, ফারুককে পুলিশ সদস্যরা মারধর করে আটকে রেখেছে। হ্যাপী সেখানে উপপরিদর্শক (এসআই) ইমদাদুল হক, মাসুদ রানা, বুলবুল আহমেদসহ অন্যদের পা ধরে তার স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার আকুতি জানান।
তখন ইমদাদুল হক হ্যাপীকে বলেন, ফারুক অনেক বড় ক্রিমিনাল, তাদের গালিগালাজ করেছেন, এমনিতে ছাড়া যাবে না। ছাড়াতে হলে এক লাখ টাকা লাগবে। তখন হ্যাপী জানান, তার স্বামী সিটি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শোয়েবের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। তিনটি শিশুসন্তানসহ এ দম্পতির সংসার তার আয়েই চলে। তাকে ছেড়ে দিন। পরে পুলিশ সদস্যরা ৫০ হাজার টাকা দাবি করা ছাড়াও তাকে কুপ্রস্তাব দেন বলে অভিযোগ করেন হ্যাপী।
মামলায় হ্যাপী আরও জানান, রাজি না হওয়ায় আসামিরা ফারুককে ব্যাপক মারধর করেন। আসামিরা বলেন, ‘ফারুক মাদক ব্যবসায়ী। তারা কিছু করতে পারবে না। তাদের বড় স্যার জানে কী করবে’। কিছুক্ষণ পর ফারুককে মোটরসাইকেলে করে বংশাল থানার দিকে নিয়ে যায়। হ্যাপী পরে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাইনুল হোসেনের হাত-পা ধরে কাকুতি-মিনতি করে স্বামীকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ওসি তাকে পরদিন সিএমএম আদালতে যোগাযোগ করতে বলেন। পরদিন হ্যাপী আদালতে গেলে মারধরের কথা জানান ফারুক। তার কিছু হলে আদালতে বিচার চাইতে বলেন। ফারুকের বিরুদ্ধে ১৫০ গ্রাম গাজার মামলা দেওয়া হয়েছে বলে জানতে পারেন হ্যাপী। বিকেলে তিনি বাসায় ফিরে যান। ১৫ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে এক ব্যক্তি হ্যাপীকে জানান, ফারুক মারা গেছেন। এরপর ঢামেক মর্গে গিয়ে তিনি স্বামীর মরদেহ শনাক্ত করেন। এ সময় ফারুকের গলায়, বুকে, পিঠে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান।
ফারুককে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে লালবাগ বিভাগের পুলিশের উপকমিশনার মো. জাফর হোসেন জানায়, ফারুক হোসেন মাদকাসক্ত ছিলেন। একটি মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হন তিনি। পরে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। দুদিন পর জেলখানায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালের চিকিৎসক ফারুককে মৃত ঘোষণা করেন। তাতে পুলিশের নির্যাতনের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?