ব্যবসায়ীর লাভ, বঞ্চিত ভোক্তা

আবু আলী ও রেজাউল রেজা
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ব্যবসায়ীর লাভ, বঞ্চিত ভোক্তা

প্রতিবছর রমজানকে কেন্দ্র করে কতিপয় অসাধু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী নানা কায়দায় ভোগ্যপণ্য থেকে বাড়তি মুনাফা তুলে নেয়। এবার রমজানের অনেক আগে থেকেই ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, ডাল, খেজুর ও পেঁয়াজের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। রোজায় নিত্যপণ্যের বাজার সহনীয় রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দৃশ্যত তৎপর হলেও কার্যত গত এক মাসে বাজারে এর প্রভাব পড়েছে সামান্যই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতিতে সুদের হার বাড়িয়ে টাকার প্রবাহ সীমিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অবৈধ মজুদদার ও কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে কড়া হুশিয়ারিও দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চারটি প্রধান নিত্যপণ্যের শুল্ক-কর কমিয়েছে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারালেও ভোক্তারা সুফল পাচ্ছেন না। শুল্ক সুবিধার পুরোটাই চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পকেটে।

জানা গেছে, গত ৮ ফেব্রুয়ারি চালের আমদানি শুল্ক-কর ৬৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। আর সম্পূরক শুল্ক কমানো হয় ২০ শতাংশ। এ ছাড়া পরিশোধিত-অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। চিনি আমদানিতে টনপ্রতি আমদানি শুল্ক দেড় হাজার টাকা থেকে কমিয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। খেজুরের ক্ষেত্রে শুল্ক ৫৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এনবিআরের এমন সিদ্ধান্তে আশা করা হচ্ছিল, ভোক্তারা এসব পণ্য কম দামে পাবেন। কিন্তু বরাবরের মতোই বাজারে এই শুল্ক ছাড়ের প্রভাব পড়েনি।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, শুল্ক সুবিধাটা দেওয়া হয় ভোক্তাদের সুবিধার্থে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, এটা কেবল ব্যবসায়ীরা ভোগ করেন। বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে তা পৌঁছায় না। এর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, কিছু সংখ্যক ‘বড় খেলোয়াড়ের’ হাতে আমদানির বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ। এখানে নতুনদের প্রবেশের সুযোগ নেই; প্রতিযোগিতা নেই। এমন বাজারে যতই শুল্ক ছাড় দেওয়া হোক, ভোক্তা পর্যন্ত সেটি পৌঁছবে কিনা, তা অনিশ্চিত। উল্টো এতে ব্যবসায়ীদের মুনাফা বাড়ে আর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্বও হারায়। এনবিআর সদস্য মাসুদ সাদিক জানান, শুল্ক কর কমানোর কারণে এনবিআরের ৭শ কোটি টাকা রাজস্ব আয় কমবে।

এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, শুধু শুল্ক-করে ছাড় দিলে তো হবে না, ভোক্তারা তাতে উপকৃত হচ্ছে কিনা, সেটিও মনিটর করতে হবে। তিনি বলেন, শুল্ক সুবিধা দেওয়ার পর কারা কারা পণ্য আমদানি করছে, কত দামে করছে, দেশের বাজারে কত দামে ছাড়ছে- এসব তথ্য জোগাড় করা কঠিন কাজ না। আমাদের প্রতিযোগিতা কমিশন রয়েছে। কিন্তু কাজে ফল পাচ্ছি না। আমাদের উচিত এই মনিটরটাও করা। তাহলে শুল্ক ছাড়ের সুবিধা ভোক্তারাও ভোগ করতে পারবেন।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, রোজায় ভোক্তা পর্যায়ে পণ্য সরবরাহ ও দাম নিয়ে যাতে কোনো বিভ্রান্তি না থাকে, সেটা দূর করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। মাসখানেক ধরে আমরা চেষ্টা করছি। রমজান শুরুর এক সপ্তাহ আগেই এর বাস্তবায়ন হবে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, যে তারিখে কারখানা থেকে তেল বের হবে, সেই তেলের বোতলে নতুন মূল্য মার্ক করা থাকবে। প্রথমে অপরিশোধিত তেল আমদানি হয়, পরে সেটা পুনর্নির্ধারিত ট্যারিফ অনুসারে খালাস হওয়ার পর কারখানায় গেলে সেই উৎপাদিত তেলেরই দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। মাঠ পর্যায়ের মনিটরিং থাকবে।

এদিকে বাজার চিত্র বলছে, নতুন করে না বাড়লেও আগের উচ্চমূল্যেই স্থির রয়েছে চাল, তেল, চিনি ও খেজুরের বাজার। খুচরা পর্যায়ে সরু চালের কেজি এখনো ৬২ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। আর মাঝারি মানের চালের কেজি ৫৬ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। চালের বাজারে এখনো অভিযান চলছে। অবৈধ মজুদদার ও কারসাজিকারীদের বারবার হুশিয়ার করছে সরকার। অনুরোধের পরও চালের দাম আশানুরূপ কমায়নি মিল মালিকরা।

এদিকে খুচরায় খোলা চিনির কেজি এখনো ১৪০ টাকার নিচে মিলছে না। এর বেশি দামেও বিক্রি হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে গেছে। খুচরায় বোতলজাত সয়াবিনের লিটার এখনো ১৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খোলা সয়াবিনের বাজার স্থিতিশীল থাকলেও পাম তেলের দাম চড়া। গত মাসের তুলনায় খোলা পাম তেলের দাম এখনো ২ শতাংশ বেশি রয়েছে। অপরদিকে খেজুরের বাজারে দাম শুধু বাড়ছেই। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের তুলনায় এবার দাম ৪০ শতাংশ বেশি রয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ যথাযথ নয়। ডলার সংকটে সাধারণ ব্যবসায়ীরা এত দিন ভোগ্যপণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারেনি। তখন সরকার নজর দেয়নি। ফলে রমজানের এসব ভোগ্যপণ্য আমদানির সুযোগ নিয়েছেন সীমিত কয়েকজন আমদানিকারক।

রাজধানীর বাদামতলীর খেজুর আমদানিকারক মো. কাকন ও এসএম ইব্রাহীমসহ অন্যান্য ব্যবসায়ী জানান, এবার ডলার সংকট থাকায় ছোট আমদানিকারকরা ব্যাংকে বারবার গিয়েও এলসি খুলতে পারেননি। যারা বড় প্রতিষ্ঠান তারা ঠিকই আমদানি করেছেন। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করছে। এতে এক হাত বেশি বদল হওয়ায় দামও বাড়ছে। গত বছরের চেয়ে এবার দাম বেশি বেড়েছে।

মৌলভীবাজারের চিনির পাইকারি বিক্রেতারাও জানান, শুল্ক ছাড় কিংবা মূল্য নির্ধারণ কোনো কিছুর প্রভাব পড়ে না। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো যে দামে সরবরাহ করে সে দামেই বিক্রি করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে পণ্য কেনার সময় পাকা রসিদ দেওয়া হয় না। দিলেও তাতে মূল্য দেওয়া থাকে না।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে শুল্ক-কর ছাড় অবশ্যই ইতিবাচক পদক্ষেপ। ভোক্তারা এর সুফল পাবে কিনা তা বহুলাংশে নির্ভর করছে বাজারে প্রতিযোগিতা ও সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি কতটুকু হয়েছে তার ওপর। এটা না হলে এ সুবিধা কেবল ব্যবসায়ীরা ভোগ করবেন, ভোক্তারা বঞ্চিত হবেন।