সরকার গঠনে জটিল সমীকরণ
ইমরানের নির্দলরাই কি নির্ণায়ক? নাকি বল আসলে বিলাওয়ালের কোর্টে? মসনদে ফের আসীন হতে ‘ঘোড়া’ কিনে জোট বাঁধতে মরিয়া নওয়াজ। কিন্তু কে আসলে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে? জটিল এক সমীকরণের মুখোমুখি পাকিস্তান। সাধারণ নির্বাচনে বিভক্ত জনরায়ে দেশটির রাজনীতিতে ঘোর অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে।
সমীকরণ যত জটিল হবে, আকর্ষণ থাকলেও তার সৌন্দর্য ততই কমবে। কারও বিশেষ স্বার্থকে হাসিল করতে চাইলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনতার মন ভেঙে যাবে আরও খানিকটা। এবং বলা বাহুল্য, পাকিস্তানের জনগণ এখনো শতভাগ গণতন্ত্রের স্বাদ পায়নি। এমনকি, এখন পর্যন্ত দেশটির কোনো প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
অনেক নাটকীয়তা ও সংশয়ের পর বৃহস্পতিবার পাকিস্তানে সাধারণ ও প্রাদেশিক নির্বাচন হয়। সাবেক ক্রিকেট তারকা এবং পদচ্যুত ও কারাবন্দি ইমরান খান ভোটে দাঁড়াতে পারেননি। তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতারা দলীয় প্রতীকে ভোটে দাঁড়াতে পারেননি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তারা ভোটে লড়েছিলেন। সেই হিসাব কষলে, ইমরানের নির্দলরাই এবার সংখ্যাগরিষ্ঠ।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক ডনের প্রতিবেদন অনুসারে, গতকাল রাত নটায় এ প্রতিবেদন তৈরির সময় পর্যন্ত পাওয়া সর্বশেষ তথ্য বলছে, ফল প্রকাশ হওয়া ২৬৪ আসনের মধ্যে পিটিআই-স্বতন্ত্ররা পেয়েছেন ৯৩ আসনে জয়; নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পিএমএল-এন ৭৫টি ও বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির দল পিপিপি পেয়েছে ৫৪টি আসন। বাকি ৪২টি আসন পেয়েছে ছোট ছোট দলগুলো। মোট ২৬৬ আসনের মধ্যে এবার ভোট হয়েছে ২৬৫টিতে। সরকার গঠনের জাদুর সংখ্যাটি হলো ১৩৪। আর এখানেই বেঁধেছে ক্ষমতা ভাগাভাগির দ্বন্দ্ব, খুব সহজে কেউ কারও শর্তে রাজি হতে পারছেন না। হয়তো কয়েক দিন এ রকম অবস্থা বিরাজ করবে। ক্ষণে ক্ষণে সমীকরণ বদলাতে দেখা যাবে।
এদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জয়ী হওয়ার তিনদিনের মধ্যেই স্বতন্ত্র নেতাদের যে কোনো দলের সঙ্গে জোট বাঁধতে বাধ্য করার হুকুম দিতে পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্টে পিটিশন পেশ করেছেন মৌলভী ইকবাল হায়দার। ডন লিখেছে, এর আগে উল্টাপাল্টা পিটিশন করার ইতিহাস আছে এই অ্যাডভোকেটের। যেমন- ২০২২ সালে ইমরান খানের বিচারের দাবিতে পিটিশন করে এক লাখ রুপি জরিমানা গুনেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন:
গণভবনে ডাক পেলেন আ. লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা
ডন গতকাল এক ফিচার প্রতিবেদনে লিখেছে- ‘চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল হননি’ ইমরান খান। কথা যে সত্যি, তার প্রমাণ মিলেছে ভোটে। ব্যাট ছাড়াই শতক হাঁকিয়েছেন (পড়–ন শত আসনে জয় পেয়েছেন) তার দলের নেতারা। কিন্তু যদি ‘ঘোড়া বেচাকেনা’র কূটখেলায় নির্দল-চ্যুত হন তারা? যেমন- গতকালই ‘বিক্রি’ হয়ে গেছেন ওয়াসিম কাদির। লাহোর-১২১ আসন থেকে জয়ী এই নির্দল যোগ দিয়েছেন নওয়াজের দলে। পিএমএল-এন থেকে প্রচারিত এক ভিডিওবার্তায় তিনি বলেছেন, ‘আপন ঘরে ফিরলাম’। অথচ ভোটের লড়াইয়ে ইমরানের এই সৈনিক হারিয়েছেন নওয়াজের প্রার্থীকে।
পিটিআই নেতা মেহের বানু কুরেশি বলেছেন, নির্দলরা অন্য কোনো দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলে তা অন্যায় হবে। কারণ, তারা ভোট পেয়েছেন ইমরান খানের কারণে। এর পরও যদি কেউ অন্য দলে ভেড়ে, তা হলে তারা জনগণের সামনে দাঁড়াতে পারবেন না বলে মনে করেন কুরেশি।
সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি তার ছেলেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। তিনি বলেছেন, এই পদে থেকে দেশকে নেতৃত্বদানের কথা মাথায় রেখেই তবে কারও সঙ্গে জোট গঠন করা উচিত পাকিস্তান পিপল’স পার্টির (পিপিপির)।
দলটির তথ্যসচিব ফয়সাল করিম কুন্ডি মনে করেন, বিলাওয়াল যদি প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন, তা হলে তার অন্য কোনো পদ নিয়ে সরকারে থাকা উচিত হবে না; বরং ‘দল ও জনতার কথা বিবেচনা করে’ তার উচিত হবে বিরোধী দলের প্রধান হওয়া।
নওয়াজ শরিফ লন্ডনে দীর্ঘদিন নির্বাসিত ছিলেন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছিল। সেই তিনিই দেশে ফিরে এবার কেতাবি অর্থে হলেও ‘সবচেয়ে বেশি আসনে জয় পাওয়া দল’কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। উল্টো চিত্র ইমরানের জন্য। যিনি এক সময় সেনাবাহিনীর ‘বরপুত্র’ ছিলেন, এখন তিনি কারাগারে।
প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি জনগণকে বিশেষ করে নারী ও তরুণদের কুর্নিশ জানিয়েছেন- যারা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবার জন্য ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু ভোটের পর বিভক্তির বাস্তবতাকে তুলে ধরে আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির নেতা আইমাল ওয়ালি খান মন্তব্য করেছেন, যারা ভোট দিয়েছেন তারা গুরুত্বপূর্ণ না, যারা ভোট গুনছেন, তারাই গুরুত্বপূর্ণ।
নানা ধরনের কারিগরি ও যোগাযোগ বিভ্রম ও বিভ্রাটের ধোঁয়া তুলে নির্বাচন কমিশন আসলে বিশেষ স্বার্থরক্ষার জন্য ভোটে কারচুপির সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন বলে ইমরান খানের সমর্থকদের অভিযোগ। তারা বিক্ষোভও করছেন। আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে এদের অনেককে গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠ। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বার্তা সংস্থা এএফপি যেমন এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছে, পাকিস্তানের রাজনীতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী