প্রশাসন-পাউবো ঠেলাঠেলি হচ্ছে না উচ্ছেদ অভিযান
রাজশাহী শহররক্ষা বাঁধ
রাজশাহীতে জেলা প্রশাসন ও পাউবো-পাউবোর টানাটানিতে আটকে গেছে পদ্মাপাড় দখলদারদের উচ্ছেদ অভিযান। কেবল শহরেই পদ্মার তীরে শহররক্ষা বাঁধ দখল করা ৬০০ জনের তালিকা জেলা প্রশাসনকে দিয়েছে পাউবো। কিন্তু উচ্ছেদ অভিযানে নামতে চায় না জেলা প্রশাসন। তারা বলছে, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের পরও সরকারি এসব জমি পাউবো নিজেদের দখলে রাখতে পারে না। অভিযানের দুদিন পর আবার দখল হয়ে যায়। বারবার এ ঘটনা ঘটে। কাজেই তারা জমি রক্ষার নিশ্চয়তা দিলেই কেবল উচ্ছেদ অভিযান চালাবে জেলা প্রশাসন, তার আগে নয়।
পাউবোর তথ্যমতে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরে চার হাজার ২৩১ ব্যক্তি নদীর জমি দখল করেছেন। এসব দখলদারের তালিকা করে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের কাছেও পাঠিয়েছে পাউবো। এ তালিকায় রয়েছে দোকানদার থেকে প্রভাবশালীদের অনেকেই। এমনকি দখলে পিছিয়ে নেই খোদ পাউবোর কতিপয় কর্মকর্তাও। সরকারি জমি দখলে নিয়ে নিজে ও আত্মীয়স্বজনসহ নির্মাণ করেছেন মার্কেট।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানাচ্ছে, রাজশাহী শহররক্ষা বাঁধজুড়ে দখলদাররা নির্মাণ করেছে বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। পদ্মার ভাঙন থেকে রাজশাহী নগরীকে রক্ষায় ১৮৫৫ সালে শ্রীরামপুর এলাকায় প্রথম বাঁধ নির্মাণ হয়। এর পর ১৮৭১ সালে প্রায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাঁধ সম্প্রসারণ করা হয়। পাউবোর আওতাধীন এই বাঁধটিতে ভর করেছেন দখলদাররা। নগরীর বড়কুঠির সামনে পদ্মায় একসময় পানি ছিল। সেখানে নৌকাও চলত। কিন্তু এখন আর পানি নেই। সেখানে গড়ে উঠেছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। দরগাপাড়ায় লালন শাহ মুক্তমঞ্চের স্থানে কয়েক বছর আগেও ছিল প্রমত্তা পদ্মার জলধারা। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে সেখানে এখন চর জেগেছে। জেগে ওঠা চরগুলো দখল করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে দোকানপাট ও স্থায়ী পাকা স্থাপনা। ব্যক্তিগত দখল ছাড়াও রাসিক ও বিজিবি নির্মাণ করেছে একাধিক পাকা ভবন। পদ্মাতীরবর্তী লালন শাহ মুক্তমঞ্চের পূর্ব ও পশ্চিমে নদীর ভেতরে নির্মাণ করা হয়েছে একাধিক পাকা ভবন। সিটি করপোরেশন নির্মাণ করেছে ভবনটি। নদীর ভেতরে বাতায়ন নামে নির্মাণ করা হয়েছে আরও একটি দ্বিতল ভবন। এর পাশেই নিজেদের জমি উল্লেখ করে দখল নিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। নগরীর বড়কুঠি, শহীদ মিনার, তালাইমারী ফুলতলা ঘাটেও এ ধরনের স্থাপনা করেছে সিটি করপোরেশন।
এ বিষয়ে রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম তুষার বলেন, রাজশাহীতে বিনোদনকেন্দ্র বলতে শুধু পদ্মা নদী। পদ্মাপাড়ের সৌন্দর্য দেখতে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভিড় জমায়। তাদের বসার জন্য কিছু ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে বরং জায়গাটি কাজে লেগেছে। আগে মাদকসেবীদের আখড়া ছিল।
এদিকে এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে জেলা প্রশাসককে জরুরি চিঠি দেয় পাউবো। চিঠিতে বলা হয়, রাজশাহী শহররক্ষা বাঁধ ও জমিতে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। ওই চিঠির সঙ্গে রাজশাহী মেট্রোপলিটন এলাকাতেই বাঁধ ঘিরে পাউবোর জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারী ৬০০ জনের তালিকাও দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে ডিসি শামীম আহমেদ বলেন, পাউবো উচ্ছেদের চিঠি পেয়ে উচ্ছেদ করি। কিন্তু কয়েক দিন পর আবার দখল হয়ে যায়। এসব দেখে লোকজন হাসাহাসি করে। কাজেই এভাবে না করে আমরা উচ্ছেদের পর তারা যদি জায়গাগুলো কাজে লাগাতে পারে, তা হলে সাত দিনের মধ্যে উচ্ছেদ করে দেব। কিন্তু সে পরিকল্পনা তারা দেয় না। শুধু উচ্ছেদের চিঠি দেয়।
পাউবোর তালিকা অনুযায়ী, চার জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুই হাজার ৯২৫ জন দখলদার নওগাঁতে। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৬১ জন ও নাটোরে ৪৪৫ জন দখল করে আছেন নদীর জমি। পদ্মা, মহানন্দা, আত্রাই, বারনই ও নারোদ নদী দখল করে তারা নানা স্থাপনা গড়ে তুলেছেন।
নওগাঁর মান্দার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের দাসপাড়ায় বন্যানিয়ন্ত্রণের বাঁধের জায়গা দখল করেছেন পাউবোর রাজস্ব কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম। তিনি নিজে ও তার স্বজনরা মার্কেট নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। বারবার পাউবো স্থাপনা সরিয়ে নিতে চিঠি দিলেও তা আমলে নেননি তিনি। এ বিষয়ে তাকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
অপরদিকে নাটোরের মাধবপুরে রেগুলেটরের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে টিনের চালার ঘর। কোথাও কোথও নির্মাণ করা হয়েছে আধাপাকা ঘর। বড়হরিশপুর এলাকায় নদীর জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে দোতলা বাড়ি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোহালবাড়ি, সদর, হরিরামপুর ও পাগলার দাঁড়া খালের ওপর নির্মিত রেগুলেটর ও বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে আধাপাকা বাড়ি। কোথাও কোথাও পাকা বাড়ি। তালিকা করে স্থাপনা সরিয়ে নিতে চিঠি দেওয়া হলেও তাতে কাজ হয়নি।
এ বিষয়ে রাজশাহী পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণকারীদের উচ্ছেদের জন্য তালিকা করা হয়। বাজেট ছিল না। এখন সেটিরও ব্যবস্থা হয়েছে। ডিসিকে চিঠি দিয়ে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। পাউবোর রাজস্ব কর্মকর্তা জহুরুলের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।