ব্যাংক খাতে খেলাপি হ্রাস ও সুশাসন নিশ্চিতে রোডম্যাপ
নানা ধরনের ছাড় দিয়েও দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। বরং এসব ছাড়ের সুযোগ পেয়ে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। আবার ব্যাংক খাতে রয়েছে সুশাসনের ঘাটতি। তবে দেরিতে হলেও ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিতে ও খেলাপি ঋণ কমাতে কঠোর হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে মোট ১৭টি কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে। এসব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ জন্য মন্দঋণ অবলোপন করার সময় এক বছর কমিয়ে আনা হচ্ছে। এতে ব্যাংক খাতে ৪৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কমবে। এ ছাড়া ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী নীতিমাল প্রণয়ন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নীতিমালার ফলে ঋণগ্রহীতাদের ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ করার প্রবণতা হ্রাস পাবে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতের সুশাসন ফেরাতে সীমাতিরিক্ত, বেনামি ও জালিয়াতির ঋণ শূন্যে নামিয়ে আনাসহ ছয়টি কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গতকাল রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের ৪২৩তম সভায় এসব কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। পরিচালক পর্ষদ তা অনুমোদন দিয়েছে। পরিচালক পর্ষদের সভা শেষে এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারহ নাছের।
জানা গেছে, আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত পরিপালনে ব্যাংক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে এসব কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ৮ শতাংশের নিচে নামানো হবে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশে নিচে নামিয়ে আনা হবে। আর ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে সীমাতিরিক্ত, বেনামি স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং জালিয়াতি অথবা প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনা হবে।
খেলাপি কমাতে ১১ কর্মপরিকল্পনা : ২০২৬ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশে নিচে নামিয়ে আনতে মন্দঋণ অবলোপনের সময় ৩ বছর থেকে কমিয়ে ২ বছর করা হবে। এ ক্ষেত্রে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হবে। শতভাগ প্রভিশন রাখলে ব্যাংকে ঝুঁকি থাকবে না বলে জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই পদক্ষেপের কারণে খেলাপি ঋণ ৪৩ হাজার ৩০ কোটি বা ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ হ্রাস পাবে।
এ ছাড়া অবলোপন ঋণ আদায়ে ব্যাংক নির্বাহীদের সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’নামে একটি পৃথক ইউনিট গঠন ও ঋণ আদায় নির্বাহীদের মূল্যায়ন যুক্ত করা হয়েছে। আর মন্দঋণ এবং অবলোপনকৃত সম্পদ বেসরকারি খাতে অ্যাসেস ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (এএমসি) কাছে বিক্রি করে ব্যাংক তাদের ব্যালেন্স শিট পরিষ্কার করতে পারবে। এই অর্থ ব্যাংকের আয় খাতে জমা করতে পারবে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
খেলাপি ঋণ কমাতে অন্যতম কঠোর পদক্ষেপ হলো ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে প্রকৃত আদায় ছাড়া সুদ অথবা মুনাফা আয় খাতে নেওয়া যাবে না। প্রকৃত আদায় না হওয়া পর্যন্ত আলাদা ব্যালেন্স শিটে রাখতে হবে। এর ফলে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ঋণকে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ হতে দেবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ইতোপূর্বে ঋণ পরিশোধে বিভিন্ন ছাড় দেওয়া হয়েছে। এসব ছাড়ের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না। এতে করে ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি ফিরে আসবে এবং ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট কমে আসবে। আর ক্যাশ ফ্লো বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি পুরনো ঋণ আদায়ের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে নতুন ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে মেয়াদি ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার সময় আন্তর্জাতিক চর্চায় ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সব ধরনের মেয়াদি ঋণ ওভারডিউ হওয়ার পর পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে ক্লাসিফাইড করতে হবে। যা বর্তমানে নয় মাসে করা হয়। এতে খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়ে যাবে বলে ধারণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেশের ব্যাংকগুলোর বিদ্যমান লিগ্যাল টিম অথবা আইন বিভাগকে শক্তিশালী করার কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে অর্থ ঋণ আদালতের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে আশা প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া অর্থঋণ আদালতের পাশাপাশি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) পদ্ধতিতে আদালতের বাইরে মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।
ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী নীতিমাল প্রণয়ন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নীতিমালার ফলে ঋণগ্রহীতাদের ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ করার প্রবণতা হ্রাস পাবে। এ বিষয়ে ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাসের বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত হলে অনেক সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। এসব খেলাপিদের বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে। তারা নতুন করে জমি বাড়ি গাড়ি কিনতে পারবেন না। এমনকি নতুন ব্যবসাও খুলতে পারবেন না।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কর্মকর্তাদের ভাতা দেওয়া হবে। এতে খেলাপি ঋণ আদায়ের গতি ফিরবে। আর ব্যাংকের নিজস্ব মূল্যায়নের পাশাপাশি তালিকাভুক্ত জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণের বিপরীতে ওই জামানত মূল্যায়ন করা হবে। এর ফলে অতিমূল্যায়িত জামানতের বিপরীতে ঋণ দেওয়া বন্ধ করা যাবে। আর সঠিক জামানত থাকলে খেলাপি ঋণের অর্থ আদায় সহজ হবে।
সুশাসন ফেরাতে ৬ কর্মপরিকল্পনা : খেলাপি ঋণ কমানোর পাশাপাশি ব্যাংক খাতের সুশাসন ফেরাতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর জন্য ছয়টি কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার পরিচালক নিয়োগে বর্তমান প্রক্রিয়া এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য নীতিমালা হালনাগাদ করা। স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে সম্মানী নির্ধারণ। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কেও নীতিমালা। আর ব্যাংক নির্বাহীদের নিয়োগ ও পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে বাছাই প্রক্রিয়া পরিবর্তন আনা হয়েছে। তাদের পদে কর্মমূল্যায়নে পারফরম্যান্স যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া এক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম না করার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকে সব ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হবে। আগামী ২০২৫ সালের ব্যাংকগুলোর পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই পদক্ষেপের কারণে পরিচালনা বোর্ড শক্তিশালী হবে, ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দূর হবে এবং প্রশাসনিক ব্যয় কমে আসবে। অন্যদিকে ব্যাংক কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে মৌলিক প্রশিক্ষণ এবং ব্যাংকিং প্রফেশানল পরীক্ষা পাস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।