দিশেহারা জান্তা সরকার বসতছাড়া সীমান্তবাসী
৬৩ মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীর বাংলাদেশে আশ্রয়
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সর্বাত্মক আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছে জান্তা সরকারের অনুগত সেনাবাহিনী; একের পর এক এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে তারা। আরাকান আর্মির বরাতে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ঐতিহাসিক মারুকইউ শহরে বেশ কয়েক দিন লড়াই চলার পর পরাস্ত হয়ে পিছু হটেছে সেনাবাহিনীর একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন; তাদের ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মির যোদ্ধারা।
এদিকে রাখাইনের এ সংঘাত মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বাংলাদেশে, বিশেষ করে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর অনেক মানুষই উদ্বেগ-আতঙ্কে এখন বসতছাড়া। যারা নিতান্তই রয়ে গেছেন, তারা এক অর্থে গৃহবন্দী, বাইরে পা ফেলতেও ভয় পাচ্ছেন।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের এলাকাগুলোতে থেমে থেমে ভেসে আসছে ওপারের গুলি-বোমার বিকট শব্দ। শুধু তাই নয়, গুলি ও মটারশেলও এসে পড়ছে বাংলাদেশের ভূখ-ে, বিশেষ করে তুমব্রুর কোনারপাড়া, মাঝেরপাড়া ও বাজারপাড়ায়। সেখানে এরই মধ্যে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তারা হলেনÑ প্রবীর চন্দ্র ধর (৫০), রহিমা বেগম (৪০) ও শামসুল ইসলাম (৫৫)। তাদের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে। গুলি-বোমায় কোনারপাড়ার কয়েকটি ঘরবাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আতঙ্কে সব কাজকর্ম ফেলে, দোকানপাট গুটিয়ে বসত ছেড়েছে তিনটি গ্রামের হাজারো মানুষ। উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বরাতে জানা গেছে, স্থানীয় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
উপরন্তু, বিদ্রোহী গ্রুপের ব্যাপক গোলাগুলির কারণে টিকতে না পেরে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৬৩ জনেরও বেশি সদস্য বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে তুমব্রুর বিজিবি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। আরও অর্ধশতাধিক বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশের লক্ষ্যে সীমান্তের ওপারে অপেক্ষমাণ, বলছেন স্থানীয়রা।
মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশ বা বিজিপির যেসব সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের কী উপায়ে ফেরত পাঠানো যায়Ñ তা নিয়ে মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা চলছে। তবে গতকাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতির তথ্য মেলেনি।
তুমব্রুর বাসিন্দা রূপলা ধর বলেন, ভোর থেকে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে। পরিবারের সবার ঘুম উড়ে গেছে। কখন কী হয়Ñ সেই ভয়ে সবাই জেগে বসে আছি। তিনি আরও বলেন, আমাদের পাশের এলাকার একটি বাড়িতে ঘরের চালের ওপর বিস্ফোরিত রকেট লান্সার এসে পড়েছে। অনেকের বাড়ির উঠানে গুলি এসে পড়েছে। এ কারণে ঘরের বাইরে পা রাখতেও ভয় হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ গতকাল বলেন, আজ ভোর থেকে মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে ব্যাপক গোলাগুলি হচ্ছে। এতে বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে আমাদের ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তবর্তী এলাকা। এলাকাবাসীকে বলা হচ্ছে, তারা যেন বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হন। তিনি আরও জানান, মিয়ানমারের বিজিপির সদস্যরা তুমব্রু সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ আশ্রয় নিয়েছে।
ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়ি তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ (ওসি) মাহাফুজ ইমতিয়াজ ভুঁইয়া জানান, মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে আহতদের মধ্যে প্রবীর চন্দ্র ধর তুমব্রু হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা। আর রহিমা ঘুমধুম ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদের স্ত্রী। জানা গেছে, আহত আরেকজন (শাসসুল ইসলাম) কোনারপাড়ার বাসিন্দা।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য খালেদা বেগম জানান, গোলাগুলিতে কোনাপাড়ার কয়েকটি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলাকায় সাধারণ মানুষের চলাচল সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, আতঙ্কের কারণে এলাকার সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী অনেকেই অন্যত্র আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে চলে যাচ্ছে।
সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে সীমান্তের ১০০ গজ দূরত্বে থাকা মিশকাতুন নবী দাখিল মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানান বান্দরবান জেলা শিক্ষা অফিসার মুহাম্মদ ফরিদুল আলম হোসাইনী।
বান্দরবান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আবদুল মান্নান জানান, রবিবার সকাল থেকে মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে গোলাগুলি বৃদ্ধি পাওয়ায় সীমান্ত এলাকার বাইশ ফাঁড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজা বনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম কুল তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন জানিয়েছেন, বিজিবি সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়িয়েছে। নিরাপত্তা চৌকিগুলোতে সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে টহল জোরদার করা হয়েছে। সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বিজিবি। তিনি জানান, গতকাল সকাল থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়ার পালংখালীর পাশর্^বর্তী মিয়ানমার সীমান্তের ভেতরে থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে এপারে। এতে আতঙ্কে রয়েছে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা। ঘুমধুমের তুমব্রু এলাকার অনেকই ঘরবাড়ি, দোকানপাট বন্ধ করে অন্যত্র সরে গেছেন।
সীমান্তের বিভিন্ন সূত্র বলছে, মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান সংঘাতে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা বাহিনীর প্রায় সব ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। শনিবার রাতে দখল করেছে তুমব্রু ৩৪ নম্বর রাইট ক্যাম্প। সীমান্তের ওই এলাকায় মাত্র কয়েকটি ক্যাম্প দখলে আছে মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর। এর মধ্যে ঢেকিবুনিয়া ক্যাম্প উল্লেখযোগ্য। এসব ক্যাম্প দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেছে আরাকান আর্মি। স্থানীয়রা বলছেন, এই ক্যাম্পগুলোর অবস্থান সীমান্তঘেঁষা। ক্যাম্পগুলোর এপারের সীমান্তে প্রচুর বাংলাদেশি জনবসতি রয়েছে। ক্যাম্পগুলো দখলের জন্য গোলাগুলি হলেই এপারের সীমান্তে চলে আসবে। হতাহতের ঘটনাও ঘটবে।
বাংলাদেশ কোনো যুদ্ধে জড়াতে চায় না। কিন্তু প্রয়োজন হলে ছাড় দেওয়া হবে নাÑ সরকারের তরফে এ মর্মে হুশিয়ার করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গতকাল সাংবাদিকদের বলেনÑ দেখুন, আমরা যুদ্ধ চাই না, কোনো যুদ্ধে জড়াতে চাই না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই আমাদের সেই নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তার মানে এই নয় যে, আমাদের গায়ের ওপর এসে পড়লে আমরা ছেড়ে দেব। আমরা সব সময়ই তৈরি আছি। আমরা মিয়ানমার সীমান্তে বিজিবির শক্তি বৃদ্ধি করেছি। আমাদের পুলিশ ও কোস্টগার্ডকেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যেন কোনোভাবেই আমাদের সীমানায় কেউ অনুপ্রবেশ করতে না পারে। অপরদিকে তুমব্রু সীমান্তে বিজিবির সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ পুলিশও, এ ক্ষেত্রে বিজিবি কোনো সহযোগিতা চাইলে তাদের আইনানুগভাবে তা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছএপারের সীমান্তে চলে আসবে। হতাহতের ঘটনাও ঘটবে।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার; টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি