বাজার-কারখানার বর্জ্যে থামছে না হালদা দূষণ

অনলাইন ডেস্ক
০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২৩:৫৩
শেয়ার :
বাজার-কারখানার বর্জ্যে থামছে না হালদা দূষণ

বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ও দেশের একমাত্র মিঠাপানির মৎস্য প্রজননক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদী। নানা কারণে দেশের মৎস্য খাত ও অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব রয়েছে। দখল-দূষণের কবলে হালদার বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে। বিলে-ঝিলে দিন দিন মাছের প্রজনন কমলেও এই হালদা দেশীয় মাছের অন্যতম প্রজননক্ষেত্র। অজস্র বাজার, শিল্পকারখানার বর্জ্যই নদীটির জন্য বড় হুমকি। দূষণের বিষে ভারাক্রান্ত হচ্ছে মিঠাপানির এ নদী।

২০২০ সালে রুই জাতীয় মাছের মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত এ নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। ফলে হালদার জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় ও মানিকছড়ি উপজেলা, চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি, রাউজান, হাটহাজারী উপজেলা এবং পাঁচলাইশ থানার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হালদা নদী এবং নদী তীরবর্তী ৯৩ হাজার ৬১২টি দাগের ২৩ হাজার ৪২২ একর সীমানার হেরিটেজ এলাকায় ১২টি শর্ত আরোপ করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন সচেতনতা ও বিভিন্ন সময় অভিযান চালালেও অনেক জায়গায় মানা হচ্ছে না এসব শর্ত। নদীর আশেপাশের বিভিন্ন বাজার কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তদারকির অভাবে দূষিত হচ্ছে এই প্রাকৃতিক সম্পদ।

নদীটির উৎপত্তিস্থল মানিকছড়ি। তবে ফটিকছড়ি, হাটহাজারি ও রাউজানের একটি বড় জায়গার ওপর দিয়ে চলেছে হালদা। এসব এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন ধরণের দূষণের কবলে পড়েছে নদীটি। ফটিকছড়ি অংশে বিভিন্ন পয়েন্টে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও মাটি কেটে নষ্ট করা হচ্ছে হালদার গতিপ্রকৃতি। পাশাপাশি ভূজপুরের নারায়ণহাট, ফটিকছড়ির নাজিরহাটসহ কয়েকটি বাজারের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে হালদায়। এরমধ্যে গরু, মুরগির বর্জ্যের পাশাপাশি এ নদীতে ফেলা হচ্ছে মানববর্জ্য। 

ফটিকছড়ির পাশের উপজেলা হাটহাজারী দূষিত হচ্ছে নানা ধরনের শিল্প কারখানার বর্জ্যে। এসব বর্জ্য সরাসরি শাখা খালগুলোর মাধ্যমে হালদায় পড়ছে ৷ হালদার তীরবর্তী কারখানাগুলোর বেশির ভাগেরই বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) নেই। যেসব কারখানায় ইটিপি আছে, সেসব কারখানার কর্তৃপক্ষ শোধনের খরচ বাঁচাতে সুযোগ পেলেই নর্দমার মাধ্যমে বর্জ্য সরাসরি নদীতে ঢেলে দেয়। এসব অপরাধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে অনেক কারখানাকে জরিমানা করা হয়েছে। কিছু কারখানার উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাটহাজারীর পাশাপাশি রাউজানেও অবৈধ মাছ শিকার, বিভিন্ন খামারের ময়লা, নদীতে বসানো জালসহ নানা প্লাস্টিক বর্জ্য এই নদীকে দূষিত করছে।

ফটিকছড়ির নারায়ণহাট এলাকার বাসিন্দা ফজলুল করিম বলেন, ‘নারায়ণহাট বাজারের বর্জ্যগুলোর হালদার পাড়ে স্তুপ করে রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি ফটিকছড়ির বিভিন্ন এলাকায় রাতে বালু উত্তোলন করে এর পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। এ বিষয়ে স্থানীয়দের সচেতন হওয়া দরকার। হালদা আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা নদী। এসব থেকে হালদাকে রক্ষা করা না গেলে নষ্ট হবে মাছের প্রজনন ক্ষমতা, বাড়বে দূষণ।’

হাটহাজারীর নাজিরহাট এলাকার কামাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের নাজিরহাট বাজারের বর্জ্যগুলোর প্রতিনিয়ত হালদায় ফেলা হচ্ছে। আজকেও পুরাতন ব্রিজ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম একজন জবাই করা মুরগীর উচ্ছিষ্ট ফেলছে৷ এছাড়া বিভিন্ন ধরণের ময়লার পাশাপাশি মানব বর্জ্যও সরাসরি এ নদীতে ফেলা হচ্ছে। নাজিরহাটের এমন দৃশ্য দীর্ঘদিনের। আশা করব জনপ্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বর্ষাকালে নদীটির দূষণ বেড়ে যায়। বিশেষ করে বৃষ্টি হলে শাখা খালগুলো দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে জমে থাকা সব বর্জ্য সরাসরি হালদায় পড়ে। এছাড়া দখল ও অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনেও নদীর বৈশিষ্ট্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে দেয়।

দীর্ঘদিন ধরে হালদা নিয়ে কাজ করছেন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘হালদায় সমসময় দূষণ হচ্ছে। মাত্রাটা বেশি বেড়ে যায় বর্ষাকালে। এখন শীতকাল হওয়ায় নদীর যে পরিবেশ সেটি ঠিক আছে। পানি ঠাণ্ডা থাকায় মাছের অক্সিজেন যথাযথ আছে ৷ তবে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময় মা মাছের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে যদি হালদার শাখা খালগুলোতে জমে থাকা বর্জ্য তুলে ফেলা হয়, তাহলে বৃষ্টির ঢলে আর এসব ময়লা নদীতে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। পাশাপাশি নদী দূষণটাও কমবে।’

ড. শফিকুল আরো বলেন, ‘নদীর উপরিভাগ ফটিকছড়ির দিকে আমরা বালু উত্তোলন আর পাড় কেটে ফেলার খবরগুলোর বেশি পাই। এসবের কারণে প্রথম নদীর তার বৈশিষ্ট্য হারায়, দ্বিতীয়ত বালু উত্তোলনের ফলে নদীর গতিপ্রকৃতি পাল্টে যায়। যার প্রভাব পড়ে মা মাছের ডিম ছাড়ার উপরে। কারণ ওপরে যে পাহাড়ি ঢলটির মাধ্যমে মাছ ডিম দেয়, সেটি এসব গর্তে এসে আটকে যায় বা কমে যায়। পাশাপাশি ১৬ টি মত খালের মাধ্যমে বিভিন্ন ময়লা হালদায় পড়ে।’

ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, ‘হালদায় বাজারের ময়লা ফেলা হচ্ছে আপনার কাছে শুনেছি। আমি দ্রুতই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব। আর সম্প্রতি অনেকগুলো অভিযান চালিয়ে বালু উত্তোলনের যন্ত্রপাতি ধ্বংসের পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়েছে। হালদার বিষয়ে কোনো ছাড় নেই।’