সক্ষমতা বাড়াতে হবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়
এলডিসি থেকে উত্তরণ
বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করবে। বিশ^বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধান অনুযায়ী স্বল্পোন্নত থেকে কোনো দেশের উত্তরণ ঘটলে রপ্তানি খাতে প্রণোদনা দেওয়া যায় না। এ কারণে পণ্য রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা বা ভর্তুকি দেওয়া থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রথম ধাপে খাতভেদে নগদ সহায়তা ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমবে। এতে পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারকরা।
ইতোমধ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণে প্রস্তুতি শুরু করেছে বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় ঠিক করতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া সাতটি খাতকে চিহ্নিত করে গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ কার্যক্রম সমন্বয় করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এ জন্য ‘সাপোর্ট টু সাসটেইনেবল গ্র্যাজুয়েশন প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাজার সুবিধা অব্যাহত রাখার বিষয়ে ডব্লিউটিওসহ বিভিন্ন ফোরামে দরকষাকষি চলছে। এ ছাড়া ১০টি দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল বা এফটিএ করার জন্য একটি তালিকা তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দেশগুলো হচ্ছে- সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন ও মালয়েশিয়া। এফটিএ করলে কী সুবিধা হবে, তা নিয়ে গবেষণা করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬ শতাংশ আসে পোশাক রপ্তানি থেকে। টেরিটাওয়েলসহ অন্যান্য সহখাত হিসাবে নিলে রপ্তানিতে পোশাক খাতের অবদান দাঁড়ায় আরও অনেক বেশি। এভাবে এক খাতের ওপর অতিরিক্ত রপ্তানি নির্ভরতাকে অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি মনে করেন উন্নয়ন সহযোগীরা। তাই ঝুঁকি কমিয়ে রপ্তানি আয় বাড়াতে পণ্যে বৈচিত্র্য আনার তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশ সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিরা।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
আইএমএফ মনে করে, একক রপ্তানি পণ্য হিসেবে তৈরি পোশাকের ওপর রপ্তানি আয়ের অতিনির্ভরতা বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁঁকি তৈরি করছে। এ অবস্থায় রপ্তানি ঝুঁকি কমাতে তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পণ্যের বহুমুখীকরণে সুনির্দিষ্ট পণ্যভিত্তিক পদক্ষেপ দরকার। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ নিয়ে ফের উদ্বেগ জানিয়েছে আইএমএফ।
সূত্র জানায়, এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি বৈশ্বিকভাবে অন্তত ১০ ধরনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে। চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে- বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা হারানোর শঙ্কা। রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য সরকার থেকে নগদ সহায়তা দেওয়া যাবে না। এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা সংকুচিত হয়ে আসবে। রপ্তানির নতুন বাজার তৈরি করা। রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য নিয়ে আসা। উন্নত দেশের জোটগুলোর সঙ্গে নেগোসিয়েশন করে সুবিধা আদায় করা। বৈদেশিক ঋণের সুদ বৃদ্ধি। ডলারের বাজারের অস্থিরতা কমিয়ে আনা। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি। বিশ্ববাজারে বিপণন ও বিনিয়োগ আকর্ষণও এক্ষেত্রে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে। সর্বোপরি, এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে বাংলাদেশের অনুকূলে বৈদেশিক অনুদান ও কম সুদের ঋণ কমে আসবে। যা দেশের অর্থনীতিতে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ কতটুকু প্রস্তুত, সে বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনাও তৈরি করছে সরকার। তবে রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে এর অগ্রগতি খুবই কম বলে জানা গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে রপ্তানি হয় বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৪৫ শতাংশ পণ্য। শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার বিকল্প হিসেবে ইইউর সঙ্গে জিএসপি প্লাস নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। জিএসপি সুবিধা ইতোমধ্যেই বাতিল হয়েছে এক দশক আগে। জিএসপি প্লাস সুবিধার বিষয়টি এখনো অনিষ্পন্ন। যার আলোচনা চলমান। ইইউতে বাংলাদেশ কতটুকু বাজার সুবিধা পাবে তার অনেকটাই নির্ভর করছে এই জিএসপি প্লাসের ওপর।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
এদিকে বিশ্লেষকরা মনে করেন, রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণের বিকল্প নেই। চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও পোশাক খাতের রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। যেমন ভূরাজনৈতিক কারণে চীন বাজার হারাচ্ছে। বাংলাদেশ এ সুযোগ নিতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশের রপ্তানি সাধারণত প্রাকৃতিক তন্তুভিত্তিক। অথচ কৃত্রিম সুতায় তৈরি পণ্যেরও ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। সেদিকে নজর দিতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, সরকারকে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। শুধু তৈরি পোশাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। উৎপাদনশীলতাও বাড়াতে হবে। রপ্তানিপণ্যের মানোন্নয়ন করে যাতে ভালো দাম পাওয়া যায়, সে চেষ্টাও করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান জানান, অচিরেই যেহেতু বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হবে, তাই তখন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে রপ্তানির ক্ষেত্রে পাওয়া নানা সুবিধা আর না-ও পাওয়া যেতে পারে। এখনই প্রস্তুতি না নিলে সে সময় আমাদের মোট রপ্তানি ৭ থেকে ১৪ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।