ইসরায়েলের ওপর চাপ বেড়েছে
আইসিজে রায়
গাজায় বেসামরিক মৃত্যু থামাতে এবং মানবিক ত্রাণ প্রবেশের সুযোগ দিতে নতুন করে চাপে পড়েছে ইসরায়েল। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিজে) ঐতিহাসিক রায়ের পর দেশটির দিকে নতুন করে চোখ রাখতে শুরু করেছে পুরো বিশ্ব। আইসিজের রায় ইসরায়েল মেনে চলবে- এমন প্রত্যাশার কথাও এসেছে পশ্চিমা অনেক দেশ থেকে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইসিজে রায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর প্রয়োগ খুবই সীমিত।
ফিলিস্তিনি উপত্যকায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনে গত ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা মামলায় গত শুক্রবার প্রাথমিক রায় দিয়েছে আইসিজে। অন্তর্বর্তী রায় ঘোষণা করে আইসিজে বিচারক জোয়ান ই ডনোফ বলেছেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই গণহত্যা কনভেনশনে বর্ণিত সব কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। এ জন্য দেশটির ‘ক্ষমতার মধ্যে থাকা সব ধরনের পদক্ষেপ’ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এ ছাড়া গণহত্যায় সরাসরি উসকানিদাতাদের শাস্তি দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলকে রায় বাস্তবায়নে বাধ্য করতে পারবে না আইসিজে। তবে রাজনৈতিকভাবে এই রায় গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েলের সামরিক ও কূটনৈতিক সহযোগীরা দেশটিকে রায় বাস্তবায়নে কীভাবে বাধ্য করায়, সেদিকে নজর রয়েছে।
রায় ঘোষণার পর এক টেলিভিশন ভাষণে মামলা দায়ের করা দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেছেন, আজ ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে দাঁড়িয়েছে, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে তাদের অপরাধ উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। আমরা আশা করব, নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করা এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা দেশ হিসেবে ইসরায়েল রায় মেনে চলবে।
আইসিজে আদালতের সবশেষ অন্যতম আদেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান। ইউক্রেনে আগ্রাসন বন্ধে রাশিয়াকে আদেশ দিয়েছিল আইসিজে। তবে সেই রায় থোড়াই আমলে নিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। শুক্রবারের রায়ের আগে থেকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলে আসছেন, ‘আমাদের কেউ থামাতে পারবে না, হেগও নয়।’ রায়ের পরও তিনি সামরিক অভিযানে কোনো পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দেননি। তবে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, আদালত যুদ্ধবিরতির আদেশ দেয়নি।
আরও পড়ুন:
রোগীর পেটে জীবন্ত মাছি!
নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি ইসরায়েলের প্রতিশ্রুতি অবিচল। দেশ ও মানুষের সুরক্ষা চালিয়ে যাওয়াও আমাদের পবিত্র প্রতিশ্রুতি। অন্যান্য দেশের মতো ইসরায়েলের আত্মরক্ষার সহজাত অধিকার রয়েছে। এই মৌলিক অধিকার অস্বীকারে ইসরায়েলকে বাধ্য করানোর জঘন্য প্রচেষ্টা ইহুদি রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে স্পষ্ট বৈষম্য এবং এটি ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রত্যাখ্যান করা হলো।’
গাজা উপত্যকার কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, গত সাত অক্টোবর হামাসের হামলার পর শুরু হওয়া যুদ্ধে গাজার এক শতাংশের বেশি- প্রায় ২৬ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। উপত্যকার ২৩ লাখ বাসিন্দার প্রায় সবাই ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবারহীন দিন পার করছে গাজার বাসিন্দারা।
এমন পরিস্থিতিতে আদালতের অন্তত ১৫ বিচারক একমত হয়ে রায় দিয়েছেন। রায় অনুযায়ী ইসরায়েলকে গণহত্যার অভিযোগের প্রমাণ সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে এবং এক মাসের মধ্যে আদালতকে অবহিত করতে হবে। আদালতের ১৭ বিচারকের মধ্যে ১৫ জনের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেওয়া রায়ে বলা হয়েছে, অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে ইসরায়েলের উচিত ফিলিস্তিনিদের হত্যা, তাদের গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা কিংবা ফিলিস্তিনি নারীদের সন্তান জন্মদানে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা আরোপ এড়াতে দেশটির ক্ষমতার আওতার মধ্যে সবকিছু করা।
আইসিজের রায়ে যেসব ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন দুজন বিচারক। তাদের একজন একজন উগান্ডার জুলিয়া সেবুটিন্ডে। তিনি রায়ের সব ক’টি বিষয়ের বিপক্ষে অবস্থান জানিয়েছেন। আর অপরজন ইসরায়েলের আহারন বারাক দুটি বিষয়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
উগান্ডার বিচারকের অবস্থান সম্পর্কে বিশ্লেষক দানিয়েল বোয়াম্বালে বলেন, বিচারক জুলিয়া বরাবর স্বাধীনচেতা। তার মনোভাব আগেভাগে ধারণা করা বেশ কঠিন। তবে এর পেছনে অন্য কারণও খুঁজেছেন তিনি। তার মতে, অনেক বিশ্লেষক মনে করেন উগান্ডা হয়তো নতুন করে শত্রু তৈরি করতে চাইছে না। কেননা সম্প্রতি সমকামিতা আইন নিয়ে দেশটি উদার পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে মার্কিনপন্থিদের রোষানলে পড়েছে। জুলিয়ার এই অবস্থানের পেছনে এটাও একটা কারণ হতে পারে। এ ছাড়া উগান্ডা ও ইসরায়েলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামরিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন এই বিশ্লেষক।
যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করা জুলিয়া প্রথম আফ্রিকান নারী হিসেবে আইসিজে বিচারক প্যানেলে স্থান পেয়েছেন। বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
গাজায় গণহত্যার অভিযোগের বিষয়ে এটি চূড়ান্ত রায় নয়। মূল রায়ের জন্য কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে। আইসিজে রায় সম্পর্কে আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক ডনের উপদেষ্টা পরিচালক বলেন, এটা ইসরায়েলের জন্য বিশাল পরাজয়Ñ অন্যতম বড় পরাজয় গত ৭৫ বছরের মধ্যে। আর লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক গেরি সিম্পসন বলেন, গাজায় ইসরায়েলের বোমা বর্ষণ সত্যিই বন্ধ করতে পারা একমাত্র প্রতিষ্ঠান ইসরায়েল। তার পরও এই রায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ন্যায়ভিত্তিক আইন মেনে চলার দাবি করা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য কঠিন করে তুলবে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আইসিজের রায়কে ইতোমধ্যে স্বাগত জানিয়েছে সৌদি আরব, কাতার, তুরস্ক, মিশর ও স্পেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) আশা প্রকাশ করেছে- ইসরায়েল ও হামাস উভয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে আইসিজে রুলিং মেনে চলবে। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্নালেনা বায়েরবক বলেছেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই রায় মেনে চলতে হবে; তবে হামাসের বাকি থাকা জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার প্রয়োজন আছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে বিচারের মুখোমুখি হতে বলেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বাস করে চলেছে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হবে না।
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস