ডালের বাজারে হঠাৎ ডামাডোল

রেজাউল রেজা
২৮ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ডালের বাজারে হঠাৎ ডামাডোল

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী দৌড়ে ছুটছে ডালের বাজারও। রোজাকে সামনে রেখে আগেভাগেই বাড়তে শুরু করেছে ছোলা, মুগ, অ্যাংকরসহ সব ধরনের ডালের দাম। আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমে যাওয়ায় বাজার চড়া রয়েছে। তবে ভোক্তারা ব্যবসায়ীদের এমন দাবি মানতে নারাজ। তারা বলছেন, প্রতিবছর রমজানের আগে ব্যবসায়ীরা ছোলাসহ সব ধরনের ডালের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেন। এবারও তেমনটা হচ্ছে।

রাজধানীর বাজারচিত্র বলছে, মুগডালের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। প্রতি কেজিতে অন্তত ৩৮ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে ১৬৮ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মানভেদে ১৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। গত মাসে যা ১৩০ টাকাতেও কেনা গেছে। এদিকে রমজানের পণ্য হিসেবে পরিচিত ছোলার বাজার এবার আগেভাগেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গত বছর প্রতি কেজি ছোলা মানভেদে বিক্রি হয়েছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। গত মাসে বিক্রি হয় ৯০ টাকায়। এখন তা এক লাফে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। অ্যাংকর ডালের দাম বেড়ে মানভেদে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত মাসে যা ৬৮ থেকে ৭২ টাকার মধ্যে কেনা গেছে। ছোট দানার মসুর ডালের বাজার অপরিবর্তিত থাকলেও মোটা দানার মসুরের ডালের দাম কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছে। গত মাসে মোটা দানার মসুরের কেজি ১০৫ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে ১১০ টাকার নিচে মিলছে না। কোথাও কোথাও ১১৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। পাইকারিতে দাম বাড়ায় খুচরায় বাড়াতে বাধ্য

হয়েছেন বলে জানান মালিবাগ বাজারের খুচরা বিক্রেতা মোহাম্মদ সোলায়মান। তিনি বলেন, সব ধরনের ডালের দাম বাড়তি এখন। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে মৌলভীবাজারের পাইকারদের থেকে ছোলার বস্তা (৫০ কেজি) ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ১০০ টাকার মধ্যে কিনতে পেরেছি। এখন ছোলার বস্তা কিনতে হয়েছে ৫ হাজার ৩৫০ থেকে ৫ হাজার ৪০০ টাকায়। যদিও এটা অস্ট্রেলিয়ান। তার পরও দাম অত্যধিক বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে মুগডালের। ১৫-২০ দিন আগেও ১৩০ টাকা কেজি বিক্রি করেছি। সেই মুগডাল এখন ১৭০ টাকার নিচে বিক্রি করতে পারছি না। মোটা মসুর ডালের কেজি এখন ১১৫ টাকা হয়েছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদন বলছে, মাসের ব্যবধানে মসুর ডালের দাম অপরিবর্তিত থাকলেও অন্য সব ডালের দাম বেড়েছে। সংস্থাটির হিসাব বলছে, গত এক মাসের ব্যবধানে মুগডালের দাম ২১ দশমিক ৫৭ শতাংশ, ছোলার দাম ৫ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং অ্যাংকর ডালের দাম ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়েছে।

ডালের বাজারের এমন ডামাডোলে আসন্ন রোজায় বাড়তি খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ভোক্তারা। মূল্যস্ফীতির এই সময়ে ডাল-ভাত খেয়েও জীবনযাপন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে নিম্ন ও খেটে খাওয়া মানুষের। কারণ, বর্তমানে চালের বাজারেও বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে।

কদমতলী এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. এনামুল হক বলেন, প্রতিবছরই রোজার আগে দাম বাড়ে। এবার তো তাই। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা হুজুগে অতিরিক্ত কেনে। এতে বাজারে দাম বেড়ে যায়। আর তার মাসুল গুনতে হয় আমাদের মতো সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষদের।

এদিকে ডালের পাইকারি ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা বলছেন, বিশ্ববাজার স্থিতিশীল থাকলেও দেশে ডলারের বাড়তি দাম ও সংকটের কারণে এ মৌসুমে এলসি খোলা কমেছে। ফলে আমদানি কমে যাওয়ায় বাজারে প্রভাব পড়েছে।

কথা হলে বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ বলেন, রোজায় বাড়তি চাহিদার কথা মাথায় রেখে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইথিওপিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি বাড়ানোর চেষ্টা ছিল আমাদের। কিন্তু আমদানি কম হয়েছে। বিশ্ববাজার ঠিকঠাকই আছে। কিন্তু দেশে ডলার সংকট। বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। এলসি খোলা কমেছে। এবার আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। তাই সব ধরনের ডালের দাম বাড়তি। তিনি বলেন, গতবার ব্যবসায়ীদের আমরা ছোলা ৭০ টাকা কেজি দরে দিতে পেরেছি। এবার সেটা ৯০-৯২ টাকা হয়েছে। তার ওপর এবার যে ছোলা এসেছে তার বড় অংশ নিম্নমানের। ফলে ভালো মানের ছোলার এখনো ঘাটতি রয়েছে।

প্রতিবছর রোজার আগে দাম বাড়ানো রীতিতে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা বেড়েছে। যার চড়া মাসুল দিতে হয় ভোক্তাকে। এমনটাই মনে করছেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, চাহিদার সঙ্গে বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের অন্যান্য দেশে রমজানে নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। অথচ আমাদের এখানে ব্যবসায়ীরা উল্টো দাম বাড়িয়ে দেন। বাজারে নৈতিক ব্যবসার বদলে লোভ বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির মতো ব্যবসায়ীদের এই ‘লোভস্ফীতিও’ বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ক্যাব সভাপতি বলেন, রোজার বাড়তি চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ বাড়াতে ছোলাসহ বেশকিছু প্রয়োজনীয় পণ্য যাতে আমদানি বাড়ে এবং সহজ হয়, সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর কাজ করছে। এই পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক। কিন্তু আমরা সব সময় দেখি সরকারের হিসাবে আমদানি সন্তোষজনক, আর ব্যবসায়ীরা বলেন কম হয়েছে। অর্থাৎ এখানে ‘ঘাপলা’ রয়েছে। আবার সরকার পণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়ে থাকে। সেটা ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছায় না। সরকারকে লক্ষ রাখতে হবে শুল্ক ছাড়ের সুফলটা যেন ভোক্তারাও ভোগ করতে পারে। সেটা যেন কেবল ব্যবসায়ীরাই ভোগ না করে।