জলবায়ু পরিবর্তন অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি করছে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি করে, বিশেষ করে পানিকে প্রভাবিত করে। মানবজাতি এবং বাস্তুতন্ত্রের জন্য যা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো এই সমস্যা আমরা যে হারে তৈরি করছি সে হারে তার সমাধানের পথ বের করতে পারছি না। আমরা কার্যকর সমাধান ছাড়া এই সংকট মোকাবেলায় অবদান রাখতে পারব না।’
আজ বুধবার রাজধানীর গুলশানের সিক্স সিজন হোটেলে দুইদিন ব্যাপী ৯ম আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। আয়োজক সংস্থা অ্যাকশন এইড ২০১৬ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে এই সম্মেলনের আয়োজন করে আসছে।
তিনি আরও বলেন, ‘পানি টেকসই উন্নয়নের অন্যতম উপাদান। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে আমাদের অবশ্যই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এটি ব্যবহার করতে হবে।’
পরিবেশমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের প্রথম ১০০ দিনের পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় একটি বিস্তৃত কর্মসূচি রয়েছে। সামগ্রিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য সরকার, বিজ্ঞানী, এনজিও এবং বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে একটি মাল্টিস্টেকহোল্ডার প্ল্যাটফর্ম গঠন করা এখন সময়ের দাবি। অনেক প্রতিশ্রুতিশীল উদ্যোগ এবং স্টার্টআপ আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু প্রধান স্টেকহোল্ডারদের অংশিদারিত্বের অভাবে প্রায়শই সেগুলি সফলতার মুখ দেখে না। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করে এমন প্রকল্পগুলি পাইলটিং করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা শুধু ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে নয়, সমাধান খোঁজার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে চাই। আশা করি এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ফলাফল আমাদের নতুন দিক নির্দেশনা দিবে। জলবায়ু ন্যায়বিচারের জন্য আমরা যে সংস্থাগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি তাদের মধ্যে একশনএইড বাংলাদেশ অন্যতম। এই প্রচেষ্টায় আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য আমি অন্যদেরও স্বাগত জানাই।’
এ বছর দশটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই পানি সম্মেলন। সেগুলো হলো জলবায়ু পরিবর্তন এবং নদীর অধিকারের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, জলবায়ু পরিবর্তন এবং নদী: ঝুঁকি ও বিপদাপন্নটা, উন্নয়ন,অন্তর্ভুক্তি এবং সহিষ্ণুতা, পানি-নদী এবং শহুরে সহিষ্ণুতা, অবকাঠামো এবং বাস্তুতন্ত্র, নদী, সহিষ্ণুতা, এবং জনগণ, নদীর অধিকার: অববাহিকার সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, বহুপাক্ষিক পানি সহযোগিতা এবং ন্যায্যতা, জীবন্ত যাদুঘর এবং স্থানীয় সম্প্রদায়সমূহের সহিষ্ণুতা এবং পানি এবং নদী তরুণদের সম্পৃক্ততা টেকসই ভবিষ্যত: প্রযুক্তিগত সমাধান তৈরি।
অস্ট্রেলিয়ার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নার্দিয়া সিম্পসন বলেন, ‘জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কূটনীতিক ও নীতিনির্ধারকদের বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। আমরা ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং দুর্যোগ দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ। তবে একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনের রোল মডেল। বাংলাদেশে আমরা সরকারের সঙ্গে কৃষিখাত উন্নয়ন এবং পানি ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে কাজ করছি। আমরা উদীয়মান নেতাদের জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি ডেল্টা কান্ট্রি। এখানে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছুই নদী ও পানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাই আমরা এবারের সম্মেলনে নদী, পানি ও জলবায়ু পরিবর্তনকে আমাদের মূল বিষয় হিসেবে নিয়েছি।’
সম্মেলনের প্রথম দিনে একশনএইড ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সোসাইটির চেয়ারপারসন ইব্রাহিম খলিল আল জায়াদ বলেন, ‘বাংলাদেশে ৮০০টিরও বেশি নদী রয়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষ তাদের নিজের ভিটা থেকে বাস্তুচ্যুত হতে। আমরা ক্রমবর্ধমান জোয়ার, অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ধরন এবং শুষ্ক ভূমি দেখতে পাই যেখানে কমিউনিটির মানুষজন সংগ্রাম করছে। কিন্তু আমরা মানুষের উদ্যম, তাদের সহিষ্ণুতাও দেখতে পাই এবং এর জন্যই আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি। এই সম্মেলন থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও সুপারিশ জলবায়ু ন্যায্যতায় অনন্য ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ভূরাজনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করে। গাজা যুদ্ধের প্রথম দুই মাসে উৎপন্ন বিশ্ব-উষ্ণায়ন নির্গমন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশের ২০টিরও বেশি বার্ষিক কার্বন ফুটপ্রিন্টের চেয়েও বেশি। জলবায়ু ভবিষ্যতকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত, মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে মূলধারায় যুক্ত করা দরকার।’
অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে এবং একই সঙ্গে পানির স্তর কমছে। সুতরাং আমরা পানির অপচয় বা দূষণ কমাতে আমাদের সচেতনতা প্রয়োজন। আমরা ৩টি প্রধান নদী ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি এবং আমাদের পানির ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে। অধিকন্তু, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানির ৯২ শতাংশই আসে বাইরের দেশ থেকে। আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলও খুব নিচু। এই সবই জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় দেশের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি আমরা নীতি ও কর্মকাণ্ডে আসি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রণীত জলবায়ু পরিবর্তন বা পানি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ২৬টি নীতি ও আইন রয়েছে, কিন্তু নীতিমালার বিষয়বস্তু কী তা অধিকাংশ মন্ত্রণালয় বা সংস্থা জানে না। সেখানে কাজগুলো সমন্বিতভাবে হয় না। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাদের গল্প বলতে হবে, অন্যথায় প্রকৃত সমস্যার সমাধান কখনোই হবে না।’
সুইডেন দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ও ডেপুটি হেড অফ ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশনের নায়োকা মার্টিনেজ ব্যাকস্ট্রম, পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের (পিআইকে) বিজ্ঞানী মোহাম্মদ মফিজুর রহমান, ওয়াটারকিপার অ্যালায়েন্সের কাউন্সিল মেম্বার শরীফ জামিল, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) ভাইস চেয়ার ড. নজরুল ইসলাম, রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন, সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের অধ্যাপক ও পরিচালক ড. সামিয়া সেলিম, ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট একরাম কবির, ব্র্যাক ব্যাংকের কমিউনিকেশনস এম হাফিজুল ইসলাম খান, সেন্টার ফর ক্লাইমেট জাস্টিস বাংলাদেশের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ ম্যানেজারসহ আরও অনেকে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?