হার্টের রিং নিয়ে সংকট কাটেনি
এক মাসের বেশি সময়েও হৃদরোগের চিকিৎসায় অত্যাবশ্যকীয় ডিভাইস হার্টের রিংয়ের (স্টেন্ট) নতুন মূল্য নির্ধারণ নিয়ে সৃষ্ট অচলাবস্থার অবসান হয়নি। এখনো আমদানি বন্ধ রেখেছে ২৪ প্রতিষ্ঠান। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের হৃদরোগীরা। সঠিক আকারের রিং না পাওয়ায় অনেকের চিকিৎসায় বিলম্ব হচ্ছে। আবার দ্বিগুণ মূল্যের রিং কিনে হলেও বাঁচার চেষ্টা করছেন বহু রোগী। এরপরও সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) দাবি, হার্টের রিংয়ের কোনো সংকট নেই। অথচ ডিজিডিএর বেঁধে দেওয়া দর নিয়েই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, বড় অংশের আমদানি বন্ধ থাকায় রিং পরানো অর্ধেকে নেমেছে। সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল রোগীদের। সংকট কাটেনি রিং পরানোর জন্য অত্যাবশ্যকীয় বেলুন ও তারেরও, যার ৮০ শতাংশই আসে ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে। কিন্তু এক মাস ধরে আমদানি বন্ধ থাকায় এসব উপকরণও আসছে না।
সম্প্রতি হৃদরোগে আক্রান্ত হন কুষ্টিয়ার মো. আজম আলী (৬৫)। হার্টে তিনটি ব্লক নিয়ে দুই সপ্তাহ আগে রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিভিডি) ভর্তি হন তিনি। গত রবিবার তার দেহে তিনটি রিং পরানো হয়। এতে একটি সরকার থেকে বিনামূল্যে পেলেও দুটি কিনতে হয়েছে নিজের টাকায়। দুটিই আমেরিকান কোম্পানির তৈরি। এতে ৯৩ হাজার করে দুটিতে লেগেছে ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। ইউরোপীয় কোম্পানির একই আকারের রিংয়ের প্রতিটির দাম ৬৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ অতিরিক্ত ৬০ হাজার টাকা গুনতে হয়েছে আজমকে।
একইভাবে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত দামে কিনতে হয়েছে মোরশেদ আলমকেও। চাঁদপুরের এই বাসিন্দার দেহেও তিনটি রিং পরানো হয়েছে। প্রতিটির আমেরিকান কোম্পানি প্রোমাস প্রিমিয়ার ও প্রোমোস এলিটের তৈরি। প্রতিটির দাম ৯৩ হাজার টাকা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রতি বছর ৩০ হাজারের বেশি হার্টের রিংয়ের প্রয়োজন হয়। এর অর্ধেক আসে ইউরোপ থেকে, অর্ধেক যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের (এনআইসিভিডি) কার্ডিওলজি বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক আমাদের সময়কে বলেন, ‘জটিলতার অবসান না হওয়া দুঃখজনক। কোনো রোগী ফিরে যাচ্ছেন। অনেকে পেলেও সঠিক আকারের না পাওয়ায় বাজেটের বাইরে গিয়ে বাধ্য হয়ে বেশি দামের রিং কিনতে হচ্ছে।’
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
গত ১২ ডিসেম্বর হার্টের রিংয়ের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণের পর ১৬ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর করেছে ডিজিডিএ। এতে উৎপাদনকারী ২৭টি প্রতিষ্ঠানের ৪৪ ধরনের হার্টের রিংয়ের দাম ৩ থেকে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। কিন্তু কতিপয় চিকিৎসকের অনৈতিকতার মাধ্যমে এ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে ২৭টির মধ্যে ২৪ কোম্পানি। এর মাধ্যমে তিনটি কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগও তুলেছে ওই ২৪ কোম্পানি।
পরে ১৭ ডিসেম্বর ওশান লাইফ লিমিটেডসহ ১১ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হাইকোর্টে এর বিরুদ্ধে রিট করেন। শুধু তাই নয়, এ মূল্য নির্ধারণের পর থেকে আমদানি বন্ধ রেখেছে ২৩ কোম্পানি। এরপর এক মাস ৭ দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো ধরনের সুরাহা হয়নি। মোট চাহিদার অর্ধেক রিং আমদানি করে থাকে এসব কোম্পানি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অচলাবস্থা নিরসনের জন্য ডিসেম্বরে ডিজিডিএতে যায় আমদানি বন্ধ রাখা কোম্পানিগুলো। রোগীদের কথা চিন্তা করে জানুয়ারির শুরুতে আলোচনায়
বসার আশ^াস দিয়ে রিট তুলে নিতে বলে ডিজিডিএতে। সে অনুযায়ী গত ১০ জানুয়ারি রিট প্রত্যাহার করা হয়। তবে এরপর দুই সপ্তাহ হয়ে গেলেও কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বসেনি ডিজিডিএ।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
মেডিক্যাল ডিভাইস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওয়াসিম আহমদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘বৈষম্যমূলক দাম প্রত্যাহার না করায় আমরা এখনো আমদানি বন্ধ রেখেছি। রোগীরা কষ্ট পেলেও আমাদের আপাতত কিছু করার নেই। কারণ, লোকসান দিয়ে আর ব্যবসা করতে পারি না। নির্বাচনের আগে ডিজিডিএ থেকে আলোচনায় বসবে বলে আমাদের আশ^স্ত করা হয়। এ জন্য আদালতে করা রিট প্রত্যাহার করতে বলা হলে আমরা করেছি। কিন্তু এরপর এখন পর্যন্ত তারা আর ডাকেনি।’
রিংয়ের মূল্য নির্ধারণ কমিটির একজন এনআইসিভিডির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন। সম্প্রতি তিনি অবসরে গেছেন। এ পদে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে আছেন প্রতিষ্ঠানটির কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল হাসান মিলন।
আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এটাই বড় কথা। বিষয়টি নিয়ে আমি সরাসরি ডিজিডিএর মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলব। এটার সমাধান দরকার। সব পক্ষের সঙ্গে বসে একটা সুরাহা করতেই হবে। দাম কমালে রোগীরা উপকৃত হবে। আবার যারা দিচ্ছে তারা বাড়তি দামে দিচ্ছে কিনা সেটাও দেখা দরকার। এক সময়ে দাম বেশি ছিল, এখন কমেছে। আমদানি বন্ধ রাখা কোম্পানিগুলোর অভিযোগও আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখতে হবে।’
তবে রিংয়ের কোনো সংকট নেই বলে দাবি ডিজিডিএর উপপরিচালক ও প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র মো. নুরুল আলমের। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘রিং নিয়ে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে নতুন করে আলোচনা হয়নি। যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে সেটাই চলছে।’
রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ডিজিডির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা শুধু আপনারা বলছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন আছে, কোনো সংকট নেই। আমদানি বন্ধ রাখা কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিলে আলোচনা হতে পারে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। দিলে সেগুলো আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’