বছর শুরুতেই বাড়তি বাড়িভাড়ার চাপ

শাহজাহান মোল্লা
২১ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বছর শুরুতেই বাড়তি বাড়িভাড়ার চাপ

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে ভোগাচ্ছে। গ্যাস, বিদ্যুতেও বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। এর সঙ্গে বছরের শুরুতেই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি। এর প্রধান ভুক্তভোগী ঢাকায় বসবাসকারী মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ। বছরের শুরতেই বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির এই খড়্গ পড়েছে তাদের ওপর। এলাকাভেদে কোথাও এক হাজার, কোথাও দুই হাজার আবার কোথাও ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বেশির ভাগ মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে বাড়তি ব্যয়ের চাপ নিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ঢাকার ভাড়া বাসায় বসবাসকারীরা। রিহ্যাবের পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকায় বসবাসকারীদের ৭০-৮০ শতাংশই ভাড়াটিয়া।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আতিকুর রহমান পরিবার নিয়ে মিরপুর-১১ নম্বর এলাকায় দুই রুমের বাসায় থাকেন। গেল বছর তার বাসা ভাড়া ছিল ১৩ হাজার টাকা। এবার জানুয়ারির শুরুতেই সেই বাসা ভাড়া ২ হাজার টাকা বাড়িয়ে ১৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া সার্ভিস চার্জ ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ তার কাছ থেকে মাসে ৩ হাজার টাকা বাড়তি নেওয়া হচ্ছে বছরের শুরুতেই। আতিকুরের আয় না বাড়ায় ৩ হাজার টাকা জোগান দিতে গিয়ে তাকে হিমশিম অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। একই অবস্থা বড় মগবাজার রেলগেট এলাকার বাসিন্দা মোক্তাদির হোসেনের। তিনিও দুই রুমের বাসায় থাকেন। বিদায়ী বছরে তার কাছ থেকে বাসা ভাড়া নেওয়া হতো ১৪ হাজার টাকা। জানুয়ারিতে ২ হাজার টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ হাজার টাকা। বাড়তি ভাড়া তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।

বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর এই হার মোহাম্মদপুর শেখেরটেক, আদাবর এলাকায়ও কম না। আদাবর ১৭ নম্বর রোডে থাকেন আজিবর মন্ডল। তিন রুমের বাসায় তার কাছ থেকে গত বছর নেওয়া হতো ২৩ হাজার টাকা। এবার সেই বাসার ভাড়া ২৬ হাজার টাকা করা হয়েছে। বেড়েছে সার্ভিস চার্জও।

বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির এই হার এলাকাভেদে ভিন্নতা রয়েছে। ভাড়া বেড়েছে বনশ্রী, খিলগাঁও, মগবাজার, যাত্রাবাড়ীসহ সব এলাকাতেই। কোথাও ২ হাজার, কোথাও ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে।

ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ রক্ষায় ১৯৯১ সালে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন করে সরকার। তবে সেই আইন কোন মন্ত্রণালয় বা কোন সংস্থা দেখভাল করবে সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। আইনে সরকার থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রতিটি এলাকার জন্য ‘নিয়ন্ত্রক’ নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যিনি ভাড়াটিয়া কিংবা বাড়িওয়ালাদের অভিযোগ শুনানির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করবেন। তবে গত ৩৩ বছরেও কোাথাও ‘বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রক’ নিয়োগ দেওয়ার কথা শোনা যায়নি। ফলে বাড়িওয়ালারা নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১-এ বলা আছে, কোনো বাড়ির ভাড়া ‘মানসম্মত ভাড়া’র অধিক বৃদ্ধি করা হলে ওই অধিক ভাড়া, ভাড়ার চুক্তিতে ভিন্ন রকম কিছু থাকলেও আদায়যোগ্য হবে না। তবে ‘মানসম্মত ভাড়া’ বলতে কত টাকা সেই বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই আইনে।

বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান আমাদের সময়কে বলেন, ঢাকার ৮০ শতাংশই ভাড়াটিয়া। বিভিন্ন সময় নানা জরিপে সেটাই উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি আইন রয়েছে। তবে সেই আইন কোন সংস্থা বা কোন মন্ত্রণালয় দেখভাল করবে তার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। তাই আইনটি যুগোপযোগী করা দরকার।

প্রতিবছর জানুয়ারি মাস এলেই নতুন ভাড়ার চার্ট ধরিয়ে দেন বাড়ির মালিকরা। রাজধানীর বৃহৎ জনগোষ্ঠী ভাড়াটিয়া হলেও তাদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মাথাব্যথা নেই নীতিনির্ধারণীদের। কাগজে-কলমে আইন থাকলেও তার সুফল কোনো ভাড়াটিয়া কোনো দিনই নিতে পারেনি। কারণ আইনে ভাড়াটিয়াদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো কথা নেই। আর বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কোন সংস্থা বাস্তবায়ন করবে, তারও সঠিক দিকনির্দেশনা নেই।

ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের এলাকায় বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর প্রবণতা সব সময়ই থাকে। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের এলাকা চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। যে এলাকায় বাড়ি ভাড়া একটু কম সেই এলাকায় ভাড়াটিয়াদের চাহিদা বেশি থাকে। চাহিদা বাড়তি থাকায় তার পুরো সুযোগ নেন বাড়ির মালিকরা। যেহেতু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই কোন এলাকায় কত শতাংশ বাড়ি ভাড়া বাড়বে তাই মালিকদের খেয়ালখুশিতে বাড়ে বাড়ি ভাড়া।

বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে বলে জানান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, যখন জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যায়। আর মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপটা অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চান বাড়ির মালিকরা। তবে এটাও মনে রাখতে হবে এমন অনেক বাড়ির মালিক রয়েছেন তাদের আয়ের একমাত্র উৎস বাড়ি ভাড়া। সেজন্য দ্রব্যমূল্য বাড়লে তারাও ভাড়া বাড়িয়ে দেন। তবে অস্বাভাবিক হারে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে সে ব্যাপারে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

ক্যাব সভাপতি বলেন, যে এলাকার বাড়ির চাহিদা যত বেশি সেই এলাকায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিও তত বেশি। সাধারণত নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত এলাকা ভাড়া বাড়ানোর প্রবণতা বেশি। অভিজাত এলাকায় ভাড়া সেভাবে বাড়ে না। কারণ সেখানে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারিভাবে বাড়ি বানিয়ে কিস্তিতে বিক্রি করে দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি। নীতিমালা করে কোনো লাভ নেই। কারণ সেটি কেউ মানে না। ভাড়াটিয়াদের জন্য একটি আইন রয়েছে; কিন্তু সেই আইনের কোনো সুবিধা কেউ কোনো দিন নিয়েছে বলে জানা নেই।

ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান আমাদের সময়কে বলেন, বাড়িওয়ালাদের অত্যাচার জীবনভর আমরা পেয়ে যাচ্ছি। বাড়িওয়ালারা কোনো দিন ভাড়াটিয়াদের অসুবিধা শুনতে চান না। ভাড়াটিয়ারা হাজার বললেও বাড়ির মালিকরা কোনো কর্ণপাত করেন না। তিনি বলেন, বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত কোনো সমস্যা কোথায় কার কাছে বলব- এই সুযোগ নেই। এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনাও নেই। কোনো কোনো এলাকায় ৫-৬ হাজার টাকা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে।

সর্বশেষ ২০২২ সালের ২৭ জুলাই প্রকাশিত জনশুমারি অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৭০৮ জন। এর মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যা ৫৯ লাখ ৭৯ হাজার ৫৩৭ জন, যা ১২টি সিটি করপোশেনের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় বাসিন্দাদের সংখ্যা ৪২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৪৫ জন। যদিও সংখ্যাটা আরও বেশি। একাদশ সংসদ অধিবেশনে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, ঢাকায় বাস করে ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ। এই হিসাবে ঢাকার ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ ভাড়াটিয়া।