হেফাজতে পুলিশি নির্যাতন, বাদীর নারাজি খারিজ
স্বর্ণ ব্যবসায়ী রাজিব কর রাজুকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের মামলায় তিন পুলিশ সদস্য নির্দোষ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে বাদীর দাখিল করা নারাজি আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। আজ রবিবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান এ খারিজ আদেশ দিয়েছেন। গত ২৭ নভেম্বর আদালত নারাজির বিষয়ে বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে আদেশ অপেক্ষমাণ রাখেন।
রাজিব কর রাজু বলেন, ‘গত বছরের ২ মার্চ আদালতে নারাজি দাখিল করেছিলাম। আবেদন দাখিলের দীর্ঘ ৮ মাস পর গত ২৭ নভেম্বর জবানবন্দি গ্রহণ করেন আদালত। এরপর গত ১১ জানুয়ারি আমি জানতে পেয়েছি আমার আবেদন খারিজ করেছেন আদালত।’
তিনি বলেন, ‘এ সংক্রান্তে পুলিশের বিভাগীয় তদন্তে আসামিরা দোষী প্রমাণিত হয়েছে। সেখানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়া হাস্যকর ছিল। ভেবেছিলাম নারাজি দিলে পুনরায় তদন্তে গেলে সত্য বেরিয়ে আসবে। খারিজ হওয়ায় আমরা হতাশ। আমরা খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করব।’
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২ মার্চ নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ)-এর ৪/৫ ধারায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী রাজিব কর রাজু ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি মামলা করেন।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
মামলায় রাজধানীর কোতোয়ালী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান, জলিল ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ফরিদ ভূঁইয়াকে আসামি করেন।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন বিচারক (বর্তমানে বিচারপতি) কেএম ইমরুল কায়েশ বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দেন।
মামলায় অভিযোগ, ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই এসআই মিজান ও এএসআই ফরিদ ভূঁইয়া সাদা পোশাকে ভুক্তভোগীর বাসায় সিলিং ভেঙে ঢুকে। কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আসামিরা ভুক্তভোগী রাজুকে হাতকড়া পরিয়ে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে। ভুক্তভোগীর বাসা তল্লাশি করে ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৩৮ টাকার স্বর্ণ এবং তার মায়ের চোখ অপারেশন করার ৪১ হাজার ৩০০ টাকা ছাড়াও বাসা থেকে মোবাইল, ল্যাপটপ থানায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে আসামিরা তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতনে ভুক্তভোগী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে চিকিৎসা শেষে তাকে আবার থানায় নিয়ে আসে আসামিরা। তাকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে বলে পুলিশ। টাকা না দিলে অস্ত্র ও মাদক মামলার আসামি বানিয়ে ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসামিকে আবারও নির্যাতন করে পুলিশ কর্মকর্তারা।
নির্যাতনে গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়ায় পরদিন ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজুকে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থানায় এনে দ্বিতীয় দফায় নির্যাতন করে এসআই জলিল। হাতের নখ উপড়ে ফেলা হয়। বাম হাত ভেঙে দেওয়া হয়। বাম পায়ে প্রচণ্ড আঘাত দিয়ে অচল করে ফেলা হয়। এরপর ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। টাকা দিলে ছেড়ে দেওয়া হবে, না দিলে মাদক মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেয়। খবর পেয়ে রাজুর বড় ভাই আশিষ কর এসআই মিজানের হাতে ২ লাখ টাকা তুলে দেন। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে সাদা কাগজে নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর লিখে রাখেন। এরপর পুলিশ হুমকি দিয়ে বলে, ‘তুই যদি মুখ খুলিস এবং তোকে যদি তাঁতীবাজার এলাকায় দেখতে পাই তবে মেরে ফেলব।’
আসামিদের নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে ভুক্তভোগী প্রায় এক বছর হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরে এ বিষয়ে ভুক্তভোগী কোতোয়ালী থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ মামলা না নিয়ে তাকে ঘুরাতে থাকেন। শেষে আদালতে মামলা করেন।
অন্যদিকে, বাদী এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আবেদন করলে অভিযোগটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং পুলিশ হেডকোয়াটার্সে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রদান করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগীয় মামলায় অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ঢাকা মহানগর পুলিশ আসামি মিজানুর রহমান, মো. আব্দুল জলিল এবং ফরিদ মিয়াকে একটি ইনক্রিমেন্ট সমপরিমাণ অর্থ আগামী ৫ বছরের জন্য কর্তনের আদেশ প্রদান করেন। আর আদালতে করা মামলায় পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিয়া কুতুবুর রহমান চৌধুরী অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি মর্মে ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করেন।
আরও পড়ুন:
১১ বছরেও বিচারে অগ্রগতি নেই