বড় চাপে ছোট পকেট

নিত্যপণ্যে নাস্তানাবুদ ভোক্তা

রেজাউল রেজা
০৬ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বড় চাপে ছোট পকেট

নিত্যপণ্যের দাম লাগামছাড়া বেড়েছে। বড় রকমের চাপে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষের পকেট। গত বছর এমন সময়ের তুলনায় এবার প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যেই ভোক্তাকে অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। কিছু ভোগ্যপণ্যের দাম দ্বিগুণ আড়াইগুণ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সারা মাসের হেঁশেল-ব্যয় সামাল দিতে গিয়েই সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষের আয় ফুরিয়ে যাচ্ছে। কুলিয়ে উঠতে পারছে না মধ্যবিত্তের পকেটও। বছরজুড়ে দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে লড়াই করে হাঁপিয়ে উঠেছেন সাধারণ ক্রেতা। নতুন বছরে তাই সবার প্রত্যাশাÑ বাজারে যেন স্বস্তি ফেরে। জিনিসপত্রের দাম; বিশেষ করে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যগুলোর দাম যেন নাগালে থাকে।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন গতকাল বাজার করতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. হেমায়েত তালুকদার বলছিলেন, ২০২৩ সাল পুরোটাই গেছে বাজার খরচের দুশ্চিন্তায়। একটার পর একটা পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কিন্তু আমাদের আয় বাড়েনি। বেতনের ৩০ হাজার টাকার সিংহভাগই খরচ হয়েছে বাজারে। আগে শুক্রবার সপ্তাহের বাজার করতাম। এখন সেটা করতে পারি না। সামান্য আলুও আধা কেজি কিনতে হয়। তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল রাজধানীর কারওয়ানবাজারে।

স্মরণ সরকার পেশায় কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক। তিনি বলেন, পেঁয়াজ, রসুন, তেল, ডাল গুনে গুনে কিনতে হয়। আয়ের সামান্য টাকা দিয়ে বাসা ভাড়ার পর পুরোটাই বাজারে খরচ হয়ে যায়। অন্যান্য খরচ মেটাতে কর্জ করতে হচ্ছে। আমাদের চাওয়া তো বেশি কিছু নয়। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, ছোট মাছ, ব্রয়লার মুরগি, ফার্মের ডিম, সবজিÑ এসব একটু কমে কিনতে পারলেই চলে যায়। কিন্তু প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দামই সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।

বাজার চিত্রও বলছে, কম দামের পণ্য হিসেবে পরিচিত অনেক পণ্য এখন আর আগের মতো সস্তা নেই। এক সময় ভাতের ওপর চাপ কমাতে আলু খেতে বলা হতো। সেই আলুর দাম চালের দামকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। বাজারে মোটা চালের কেজি এখন ৫০ থেকে ৫২ টাকা। সেখানে এক কেজি আলুর দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা। আলু ভর্তা-ডালও এখন বেশ খরুচে খাবার।

প্রোটিনের সহজলভ্য উৎস হিসেবে পরিচিত ব্রয়লার মুরগি ও ফার্মের ডিমের দাম এখন অনেকের নাগালের বাইরে। আগের বছর এমন সময় ব্রয়লারের কেজি ছিল ১৪৫ টাকার আশপাশে। বর্তমানে তা ২০০ টাকা ছুঁইছুঁই। ফার্মের বাদামি ডিমের হালি ছিল ৩৫ টাকা। এখন ৪৫ টাকা। কম দামের সবজিও শীতের মৌসুমে আগুন দামে বিক্রি হচ্ছে। সস্তার পাঙাশ মাছের দাম ২০০ টাকা কেজি ছাড়িয়ে গেছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরে পণ্যের মূল্য তুলনা করলে দেখা যায়, প্রতিবেদনে উল্লিখিত ৩২টি নিত্যপণ্যের মধ্যে ২৭টি পণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আলুর দাম। এ নিত্যপণ্যটির দাম দেড়গুণেরও বেশি (১৬৬ শতাংশ) বেড়েছে। পেঁয়াজের দাম ১২০ থেকে ১৬২ শতাংশ এবং রসুনের দাম ১০০ থেকে ১৪৮ শতাংশ বেড়েছে। আদাও গত বছরের চেয়ে বর্তমানে ৮০-১০২ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। জিরার দামও ৯৬ শতাংশ বেড়েছে। হলুদ, দারুচিনি, এলাচ, ধনে, তেজপাতার দামও তথৈবচ।

এক বছরে চিনির দাম ২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগিতে ২৬ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং ফর্মের ডিমে ১৯ দশমিক ১৮ শতাংশ বেড়েছে। সরু চালে দেড় শতাংশ, খোলা পাম তেল ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ, বড় দানার মসুর ডাল ৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ, মুগ ডাল ৪ শতাংশ, অ্যাংকর ডাল সাড়ে ৩ শতাংশ, ছোলা ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ দাম বেড়েছে। সবজি ও কাঁচামরিচের দামও অনেক বেড়ে গেছে। লবণের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। মাছের দামও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ৯ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। খাদ্যে মূল্যস্ফীতিও অসহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এমন উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পেরে উঠছে না মজুরি। মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে মজুরি সে হারে বাড়েনি। গত বছর নভেম্বর মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ জিনিসপত্রের দাম বাড়ার হার মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে ১ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি। এ ব্যবধান মেটাতে ঋণ করতে হচ্ছে সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষের।

সদ্য সমাপ্ত ২০২৩ সালে দেশের অর্থনীতিতে বড় চাপ ছিল মূল্যস্ফীতি এবং নতুন বছরেও এ চাপ নিয়ন্ত্রণই অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে মনে করেন তিনি। আমাদের সময়কে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক এই মুখ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। নীতিসুদহার নির্ধারণের কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, তবে পরিবর্তনগুলোতে জড়তা দেখা গেছে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেতাবি নীতির বাইরে গিয়ে যে সব কৌশল নেওয়া হয়েছে, সেগুলো কাজে তো আসেইনি, উল্টো মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আগের বছরের চেয়ে ২০২৩ সালের শেষে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনেকটাই কম অস্থিরতা ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের মধ্যেও তেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়নি। অথচ দেশের অর্থনীতিতে এর প্রতিফলন নেই। বর্তমানে বৈশ্বিক কারণগুলোর চেয়ে আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোই বরং আগে সমাধান করতে হবে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪৯ হলেও স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে তা ডাবল ডিজিটের চেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে। জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে সীমিত আয়ের মানুষ পেরে উঠছে না। আমাদের সবার আগে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যদিও মূল্যস্ফীতির বাইরে কৃত্রিমভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম অতিরিক্ত বাড়াচ্ছেন অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা।

ড. জাহিদ আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক নীতিতে গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে পণ্য বাজারে নজরদারি জোরদার করতে হবে। যারা কারসাজি করে অতিরিক্ত দাম বাড়াচ্ছে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি ট্রাকসেলের মতো ভর্তুকি মূল্যে প্রয়োজনীয় পণ্য নিম্নআয়ের মানুষের কাছে আরও বেশি পৌঁছে দিতে হবে। এর পরিধি ও উপকারভোগী আরও বাড়াতে হবে।