কেন্দ্রে ভোটার টানাই চ্যালেঞ্জ

মুহম্মদ আকবর
০৪ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
কেন্দ্রে ভোটার টানাই চ্যালেঞ্জ

দুয়ারে কড়া নাড়ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ভোটগ্রহণ আগামী ৭ জানুয়ারি। সেই হিসাবে আর মাত্র দুদিন বাকি। ভোট বর্জনকারী বিএনপি ও সমমনা দলগুলো চাইছে, ভোটাররাও এ নির্বাচন বর্জন করুক। এ লক্ষ্যে চলছে তাদের প্রচারণা। এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রত্যাশা- ভোটারের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন। সেটি দেখার অপেক্ষায় তারা। এমতাবস্থায় ভোটারদের কেন্দ্রে টানা বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে নানা কৌশলে এগিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। দলের তৃণমূল পর্যায়ে রয়েছে কেন্দ্রের কড়া নির্দেশনা। পাশাপাশি অতিউৎসাহীদের কারণে ভোট যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেদিকেও দৃষ্টি রাখছে আওয়ামী লীগ। এসবের মধ্যেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতিতে এগিয়ে চলেছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ট্রেন।

নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসীন হয় আওয়ামী লীগ। টানা তিন মেয়াদে সরকার অপরিবর্তিত থাকায় স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে ও সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে ভোটাররা ছিলেন কেন্দ্রবিমুখ। তাই এবারের জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে আওয়ামী লীগে রয়েছে শঙ্কা-উদ্বেগ। এ থেকে উত্তরণে অর্থাৎ কেন্দ্রে ভোটার টানতে এবার চারটি প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে আওয়ামী লীগ- নৌকার প্রার্থী দেওয়ার পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী রাখা; ভোটারদের কেন্দ্রে আনা এবং ভোট বাড়ানোর জন্য ডিজিটাল ক্যাম্পেইন; সরকারের উন্নয়ন তুলে ধরে সুন্দর আগামীর প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও সরকারের সরাসরি সুবিধাভোগীদের ক্যাম্পেইনে যুক্ত করা এবং সারাদেশে গঠিত ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটির তৎপরতার মাধ্যমে ভোটারদের কেন্দ্রে টানা।

কেন্দ্রে ভোটার টানা নিয়ে যখন চ্যালেঞ্জে আওয়ামী লীগ, তখন অভিযোগ উঠেছে, নৌকার ‘অজনপ্রিয়’ প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভোট কমাতে তাদের অনুসারী ভোটারদের বাসায় বাসায় গিয়ে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। কেন্দ্রে এমন অনেক অভিযোগ এসেছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে ভোটগ্রহণের শেষ সময় অবধি দলটি ভোটারদের কেন্দ্রে আনার চেষ্টায় থাকবে বলে জানা গেছে। যদিও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করবে।

এদিকে গতকাল সকালে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, তিনি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চান। সে অনুযায়ীই আওয়ামী লীগ এগোচ্ছে। পাশাপাশি বাইরের কোনো দেশ বা সংস্থার হুমকিকে তিনি পরোয়া করবেন না বলেও স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। জনগণ ছাড় তিনি কাউকে পরোয়া করেন না। এ ছাড়া তিনি নৌকায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করে, বিএনপি-জামায়াতের নৃশংসতার যোগ্য জবাব দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠান, দেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

আওয়ামী লীগের জনসংযোগ কার্যক্রমে দেখা গেছে, কেন্দ্রে ভোটার আনতে নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন নৌকার প্রার্থী ও দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী। নিবন্ধিত ২৮টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিলেও নির্বাচন

জমানোর মতো সে রকম দল মাঠে নেই। নৌকার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী মূলত একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এদিকে মিত্র দল ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে ৩২ আসনে আওয়ামী লীগ সমঝোতা করে নৌকার প্রার্থীকে সরিয়ে দিলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ঠিকই মাঠে রাখা হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীকে বাদ দিলে এসব আসনে নির্বাচনী আমেজ থাকবে না বলেই মনে করছে দল। এ ছাড়া হাইকমান্ডের নির্দেশে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে কড়া নাড়ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। পথসভা, উঠান বৈঠক, চায়ের আড্ডায় বসছেন। শুধু তাই নয়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, দলটির সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীসহ দলের বিভিন্ন উইং কাজ করছে ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে; নজর রয়েছে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমেও। পাশাপাশি আসনভিত্তিক প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী তৈরি, ভোটারদের তথ্যসংবলিত মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য নেতাদের ভোটের মাঠে প্রচারে নামানো হয়েছে। এ জন্য ৬ লাখ কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জেন, নারী ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে নিয়ে কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি করা হয়েছে।

গত ২৬ নভেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটকেন্দ্রে আনার কথা বলেন। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রে ন্যূনতম ৫০-৬০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিও নিশ্চিত করার কথা বলেন তিনি।

এ ছাড়াও ভোটার আনার কৌশল হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে বয়স্ক ভাতা, বিধবা বা স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের ভাতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা, শহিদ পরিবার ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সম্মানী ভাতা, ভিডব্লিউবি, ভিজিএফ, ভিজিডি, জিআর, টিআর, ওএমএস, টিসিবির সামাজিক সুরক্ষার উপকারভোগীদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন। সরকারের সুবিধাভোগীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্য তাদের পাশে থেকে তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার জন্য আওয়ামী লীগের কর্মীরা রয়েছেন।

একাধিক জনসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছেন। কারণ তরুণ ভোটাররা ভোট উৎসেব শামিল হয়েছেন। তাই কোনো জবরদস্তি নয়। বরং ভোটাররা কেন কেন্দ্রে আসবেন, তা বোঝাতে হবে। এটি বোঝাতে পারলেই সাধারণ মানুষ ভোটকেন্দ্রে আসবেন। এ জন্য ভোটারদের দরজায় যেতে হবে নৌকার প্রার্থীদের।

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ভোটার আকৃষ্ট করতে ‘রোড টু স্মার্ট বাংলাদেশ’ ক্যাম্পেইন করছে আওয়ামী লীগ। এর আওতায় ২০০ মাস্টার ট্রেইনারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসব মাস্টার ট্রেইনার সারা দেশে ৬ লাখ নেতাকর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান ৬ লাখ কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। প্রশিক্ষিত এ কর্মী বাহিনী মাঠে কাজ করছেন, তারা ভোটারদের ঘরে ঘরে যাচ্ছেন। তাদের একেকজন আছেন ২০০ ভোটারের দায়িত্বে। এ প্রক্রিয়ায় তারা ১২ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। প্রশিক্ষিত ৬ লাখ কর্মী সব ভোটারের ঘরে পৌঁছানোর লক্ষ্য নির্ধারণের এ উদ্যোগকে বলা হচ্ছে অফলাইন ক্যাম্পেইন। আর মাস্টার ট্রেইনাররা সরাসরি মাঠপর্যায়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য তার ভাবনা তুলে ধরছেন। পাশাপাশি বিরোধী দলের অপপ্রচারের পাল্টা বক্তব্য তুলে ধরছেন, যা ভোটারদের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে। এই উদ্যোগ সমন্বয়ের জন্য একজন ফোকাল পয়েন্ট নিযুক্ত করা হয়েছে। কর্মীদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে কাজ করছে কেন্দ্রীয় কল সেন্টার। এ ছাড়া এই পুরো কর্মযজ্ঞ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সমন্বয় করছে এক তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ দল। এ প্রচারে আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) পাশাপাশি আরও অন্তত তিনটি সেল নির্বাচন নিয়ে কাজ করছে। তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনবলের পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনের তরুণরা এসব নেটওয়ার্কের সঙ্গে কাজ করছেন। এ জন্য দলের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলায় রয়েছে প্রশিক্ষিত প্রায় ২০ হাজার কর্মী। তাদের সঙ্গে কেন্দ্র থেকে বিভিন্নভাবে সমন্বয় করা হচ্ছে। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পরামর্শে আরও বেশ কয়েকটি সংস্থা ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর কাজ করছে বলে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-৮ আসনে নৌকার প্রার্থী আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলার সময়ও ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানান ভোটকেন্দ্রে আসার। তিনি এ সময় বলেন, বিএনপি-জামায়াত মানবরূপী অগ্নিসন্ত্রাসী। এরা দুর্বিনীত দানব। এদের পরাজিত করতে না পারলে দেশকে ধ্বংস করে ফেলবে। এরা আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়। এরা দেশের ১৬ কোটি মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এদের পরাজিত করতে ৭ জানুয়ারি আপনারা ভোটকেন্দ্রে আসুন।

দিনাজপুর-২ আসনে নৌকার প্রার্থী ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানান, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তার আসনসহ সারাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। তার বিশ^াস ৭ জানুয়ারি জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটগ্রহণ কার্যক্রমে আসবেন এবং শৃঙ্খল পরিবেশে ভোটদান করবেন।