জ্বালানি তেল সরবরাহে টানটান পরিস্থিতি

লুৎফর রহমান কাকন
২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
জ্বালানি তেল সরবরাহে টানটান পরিস্থিতি

জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থায় টানটান অবস্থা চলছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) অনেকটা ‘দিন আনি দিন খাই’ প্রক্রিয়ায় সরবরাহ চেইন ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। ডিজেল ও বিমানের জেট ফুয়েল মূলত বিদেশ থেকে আমদানি করে সরবরাহ করা হয়। এ দুটো জ্বালানির রিজার্ভই কাক্সিক্ষত মাত্রায় নেই। বিশেষ করে জেট ফুয়েলের রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। কাল-পরশুর (শুক্র-শনি) মধ্যে দুটো জেট ফুয়েলবাহী জাহাজ বাংলাদেশে তেল নিয়ে না ঢুকলে জেট ফুয়েল সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটতে পারে।

অবশ্য বিপিসির ভাষ্য, ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেট ফুয়েলের রিজার্ভ রয়েছে। ইতোমধ্যে ১১ হাজার টন তেল নিয়ে একটি জাহাজ বাংলাদেশের সীমায় প্রবেশ করেছে। এ ছাড়া ২২ হাজার টন জেট ফুয়েল নিয়ে আরেকটি জাহাজ শনিবার বাংলাদেশে আসবে। ফলে জেট ফুয়েলের সংকট হবে না।

বিপিসি বলছে, টানটান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মূলত ডলার সংকটের কারণে। কয়েকজন সরবরাহকারী যথাসময়ে পেমেন্ট না পাওয়ায় তেল সরবরাহে দেরি করেছে। তাই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে তেলের কোনো সংকট হবে না। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই নিরাপদ রিজার্ভ তৈরি হয়ে যাবে। আগে থেকে অর্ডার করা সব জাহাজই যথাসময়ে আসবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ আমাদের সময়কে বলেন, বিমানের জেট ফুয়েল মূলত হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং দেশের অভ্যন্তরীণ এয়াপোর্টগুলোতে ব্যবহার হয়। সর্বাধিক প্রয়োজন হয় শাহজালালে। পদ্মা অয়েল কোম্পানির গোদনাইল ডিপো থেকে জেট ফুয়েল বিমানবন্দরে পাঠানো হয়। এ ছাড়া নিকটবর্তী ডিপোগুলো থেকে অন্যান্য বিমানবন্দরে পাঠানো হয়। তিনি বলেন, ৩১ ডিজেম্বর পর্যন্ত জেট ফুয়েল রিজার্ভ রয়েছে। ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে আরও ৩৩ হাজার টন জেট ফুয়েল চলে আসবে দুটি জাহাজে।

তিনি বলেন, শুধু এ দুটো জাহাজই নয়, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসেও প্রয়োজনীয় জেট ফুয়েল আমদানির শিডিউল তৈরি করা আছে। ফলে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি, জ্বালানি তেল সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো সংকট হবে না। তিনি বলেন, জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়টি বিপিসি নিবিড় মনিটরিং করছে। তিনি বলেন, বিপিসির হিসাবে পর্যাপ্ত টাকা থাকলেও ডলারের কিছুটা সংকট আছে। এ কারণেই তেল সরবরাহে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বছরজুড়েই বিপিসি ডলার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ডলার সংকটের জেরে ব্যাংকগুলো সময়মতো এলসি না খোলায় বিপিসির সংকট বেড়ে যায়। সময়মতো এলসি খোলা এবং তেল সরবরাহকারীদের পাওনা টাকা পরিশোধ করতে না পারার কারণে নির্ধারিত সময়ে তেল সরবরাহ অনেক ক্ষেত্রে বিঘিœত হয়েছে। ফলে কক্সিক্ষত তেলের রিজার্ভ কমেছে।

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, বিপিসির কাছে তেল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো ২৪৭ মিলিয়ন ডলার পাওনা হয়েছে। ডলার সংকট কাটাতে বিপিসি দফায় দফায় জ্বালানি বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করলেও প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ বাড়েনি। ফলে নানা কৌশলে বিপিসি জ্বালানি তেল আমদানি অব্যাহত রেখেছে। এদিকে ডলার সংকটের কারণে দিন দিন তেল সরবরাহকারীদের পাওনার পরিমাণ বাড়ছে। এমতাবস্থায় কিছু কোম্পানি তেল সরবরাহে অনীহাও প্রকাশ করেছে।

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, চলতি ডিসেম্বরে ১০টি তেলের জাহাজ পাঠানোর কথা ছিল সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর। এগুলোর মধ্যে ৫টি জাহাজই পেমেন্ট জটিলতায় বিলম্বে সরবরাহ করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ২৯ বা ৩০ ডিসেম্বরের জেট ফুয়েল আমদানি যদি কোনো কারণে বিঘ্নিত হয়, তাহলে বিমানের জ্বালানি তেল সরবরাহে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হবে। এ কর্মকর্তা বলেন, নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

এদিকে গতকাল দেশের বেশ কয়েকটি ডিপোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তেলের রিজার্ভ আছে। তবে কিছুটা কম। বিশেষ করে ডিজেলের রিজার্ভ কমেছে। এমন হওয়ার কারণ কি জানতে চাইলে বেশ কয়েকজন জানান, ১৮ ডিসেম্বরের পর অনেক ডিপোতে ডিজেলের আর কোনো চালান ঢোকেনি।

মেঘনা অয়েল কোম্পানির জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এখনো তেলের সংকট হয়েছে বলা যাবে না। তবে রিজার্ভ কিছুটা কমেছে। নতুন তেল ডিপোতে ঢুকলে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সামনে সেচ মৌসুম। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ও অবহিত। সঠিক সময়ে নিশ্চয় জ্বালানি তেলের পর্যাপ্ত আমদানি ও সরবরাহের ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে করা হবে। এ কর্মকর্তা আরও বলেন, জ্বালানি তেল ব্যবসার সঙ্গে যেসব ব্যবসায়ী জড়িত তাদের মধ্যে অনেকেরই অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই তারা গুজব ছড়ায়। গুজবকে পুঁজি করে এসব ব্যবসায়ী তেলের মজুদ করে। এ কর্মকর্তা বলেন, বিপিসি এবং তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর মনিটরিং ছাড়াও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মনিটর বাড়ানো উচিত। যাতে তেল ব্যবসায়ীরা ডলার সংকট এবং তেলের তুলনামূলক রিজার্ভ কম থাকাকে পুঁজি করে তেলের মজুদ না করতে পারে।