সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দ্রব্যমূল্য নাগালে রাখার অঙ্গীকার

১১ বিষয় প্রাধান্য দিয়ে আ.লীগের ইশতেহার

নিজস্ব প্রতিবেদক
২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দ্রব্যমূল্য নাগালে রাখার অঙ্গীকার

‘স্মার্ট বাংলাদেশ : উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ শিরোনামে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। দ্রব্যমূল নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি দূরীকরণ, সুশাসন এবং দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়নকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে এবারের ইশতেহারে। এতে ১১টি বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ের গ্র্যান্ড বলরুমে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে এই ইশতেহার উপস্থাপন করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি ইশতেহারের বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দ্রব্যমূল্য ও জনগণের আয়ের মধ্যে সঙ্গতি প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার তুলে ধরেন।

ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক স্বাগত বক্তব্য দেন। এরপর আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার অনিবার্যতা নিয়ে বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

১১ বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার : ৯৮ পৃষ্ঠার ইশতেহারে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দলীয় অবস্থান, গত ১৫ বছরের অর্জন এবং আগামী দিনের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। এতে শুরুতেই ‘আমাদের বিশেষ অগ্রাধিকার’ শিরোনামে ১১টি বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অগ্রাধিকারের তালিকায় বলা হয়- ১. দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, ২. কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, ৩. আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা, ৪. লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষিব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, ৫. দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো, ৬. ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, ৭. নিম্নআয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা, ৮. সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা, ৯. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, ১০. সাম্প্রদায়কিতা এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা এবং ১১. সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো।

ইশতেহারের প্রতিটি অংশ ঘোষণাকালে আলাদা আলাদা করে ব্যাখা দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘নির্বাচিত হলে আওয়ামী লীগ সরকার লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিকৌশল গ্রহণ করবে। বাজারমূল্য ও আয়ের মধ্যে সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা করা হবে।’ বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশ একটি গতিশীল ও দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মর্যাদা লাভ করেছে।’

ইশতেহারের গুরুত্বপূর্ণ দিক : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারটিকে প্রধান চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। এর প্রথমেই রয়েছে ‘আমাদের বিশেষ অগ্রাধিকার’। দুই নম্বরে রয়েছে ‘পটভূমি’। তৃতীয় ভাগে রয়েছে ইশতেহারের মূল অংশ ‘সরকার পরিচালনায় তিন মেয়াদে (২০০৯-২০২৩) উন্নয়ন ও অগ্রগতি এবং আমাদের অঙ্গীকার ২০২৪-২০২৮’। এ ভাগে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া, সুশাসন প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তাসহ কয়েকটি অধ্যায় রয়েছে। ইশতেহারের চতুর্থ ভাগে রয়েছে ‘বিশ^নন্দিত রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সম্ভব হবে অঙ্গীকার বাস্তবায়ন’। ইশতেহারের পটভূমিতে বিগত সময়ে দেশ গড়ার কাজে আওয়ামী লীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা এবং দলটির শাসনকালে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা হয়।

স্মার্ট বাংলাদেশ : ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ‘দিনবদলের সনদ’ শিরোনামে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি এবং পরবর্তীকালে এর বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এবারের আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বলা হয়, আওয়ামী লীগ দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে দেশ ও সমাজের উন্নতি নিশ্চিত করবে এবং গড়ে তুলবে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। এতে ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগ ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি স্তম্ভ রয়েছে- স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট নাগরিক। এ বিষয়ে অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলা হয়, স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ অব্যাহত রাখবে।

সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা : ইশতেহারের মুল অংশে এরপরই ‘সুশাসন’ অধ্যায়ে বলা হয়, নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করলে সর্বস্তরে সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা আরও সুদৃঢ় করা হবে। শিক্ষিত, দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত লোকজনকে রাজনীতিতে আসার জন্য আগ্রহী করা তোলা হবে। এ বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘গণমানুষের দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে আসছে। মানুষের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিতে আমরা সদাতৎপর। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি কার্যকর সংসদই পারে কেবল জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে। আমরা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে রাষ্ট্র পরিচালনার সকল ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা আরও সুদৃঢ় করব।

ইশতেহারের এই অংশে জনকল্যাণমুখী প্রশাসন গড়ে তোলার পাশাপাশি দ্রব্যমূলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি কর্মচারীদের নতুন বেতন কাঠানো নির্ধারণের অঙ্গীকার করা হয়। এ ছাড়া জনবান্ধব ও জবাবদিহিমূলক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয় ইশতেহারে। এতে আরও বলা হয়, আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা এবং সুবিচার নিশ্চিত হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা হবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীনতা এবং কার্যকারিতা সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। সাংবাদিকরা যাতে নির্যাতন, ভয়ভীতি-হুমকি, মিথ্যা মামলার সম্মুখীন না হন তার ব্যবস্থা করা হবে। এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, সাংবাদিকদের জন্য দশম ওয়েজবোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া চলমান। সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় সাংবাদিকদের আর্থিক ও চিকিৎসা সহায়তাকে আরও সম্প্রসারণ করা হবে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি : দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় ইশতেহারে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলার জন্য পাঠক্রমে দুর্নীতির কুফল ও দুর্নীতি রোধে করণীয় বিষয়ে অধ্যায় সংযোজন করা হবে।’ এ ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দূর করার অংশ হিসেবে ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে জোর দেওয়া হয় ইশতেহারে। এ বিষয়ে শেখ হাসিনা ই-নামজারিসহ ডিজিটাল ভূমিব্যবস্থা সম্প্রসারণের অঙ্গীকার করেন।

ইশতেহারে বলা হয়, পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয় রোধ, ঋণ-কর-বিল খেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি প্রদান এবং তাদের অবৈধ অর্থ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং এক্ষেত্রে ব্যাংক যাতে বিধি নির্ধারিত সঞ্চিতি রাখে তা নিশ্চিত করা হবে।

শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াবে আওয়ামী লীগ : শেখ হাসিনা বলেন, শিক্ষার উন্নয়ন ও বিকাশ হলে সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য নিরসনে গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। এই বিশ্বাস থেকে আওয়ামী লীগ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াবে এবং তার কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করবে। তিনি বলেন, নির্বাচিত হলে আওয়ামী লীগ সরকার নিষ্ঠার সঙ্গে সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে শিক্ষানীতির লক্ষ্য অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করবে। বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য উপযুক্ত ল্যাবরেটরি গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে।

গ্রামে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা : গ্রামের যুবসমাজের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা কমাতে গ্রামেই আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, তার দল নির্বাচিত হলে দেশের রূপান্তর ও উন্নয়নে তরুণ ও যুবসমাজকে সম্পৃক্ত রাখা হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ : আগামীতে আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করলে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁঁকি মোকাবিলার উৎপাদনশীল ও সামাজিক বনায়ন ২০ শতাংশে উন্নীত; ঢাকা ও অন্যান্য বড় নগরে বায়ুর মান উন্নয়ন; শিল্পবর্জ্য শূন্য নির্গমন, নগরে জলাভূমি সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষা এবং সমুদ্র উপকূলে ৫০০ মিটার বিস্তৃত স্থায়ী সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হবে।

প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা : আগামীতে সরকার গঠন করলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পূর্বের ন্যায় সহযোগিতার সম্পর্ক অব্যাহত রাখবে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা বলেন, ‘যুদ্ধ নয়, শান্তিতে আমরা বিশ্বাসী’। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ তার ভূখ-ে জঙ্গি, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর উপস্থিতি রোধে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ’

সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা : এ বিষয়ে শেখ হাসিনা ইশতেহারে উল্লিখিত অঙ্গীকারের কথা তুলে ধরে বলেন, ফোর্সেস গোল ২০৩০-এর আলোকে প্রতিরক্ষা বাহিনীর দক্ষতা ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনার উন্নতি অব্যাহত থাকবে। সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকদের পেশাগত দক্ষতা এবং তাদের চাকরির সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকবে।