হয়রানির কথা বলতে গিয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের সামনে কাঁদলেন চালক

রাজশাহী ব্যুরো
২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯:৪৭
শেয়ার :
হয়রানির কথা বলতে গিয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের সামনে কাঁদলেন চালক

‘আমার বাড়ি নাটোর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে। আসা যাওয়া করতে ৩০০ টাকা খরচ হয়। প্রথম লাইসেন্স করি ২০১৪ সালে। আমার লাইসেন্সের বয়স ১০ বছরের বেশি। এখন আমার হেভি লাইসেন্স প্রয়োজন। দুইমাস আগে ব্যাংক ড্রাফট করি। সব প্রসেস শেষ হলো। লাইসেন্স করতে গেলাম। আমাকে বলল, লাইসেন্স অনলাইন হয়নি। লাইসেন্স আমার জিরো হয়ে গেছে। আবার নতুন করে লাইট লাইসেন্স নিতে হবে। এতে আমি ভারী গাড়ি চালাতে পারব না। সেজন্য চার মাস হলো আমার চাকরি চলে গেছে।’

গণশুনানিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারকে পেয়ে ভোগান্তির কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন আবদুল মমিন নামের এক বাসচালক। 

বিআরটিএ চেয়ারম্যানের কাছে মমিন আরও বলেন, ‘আমার সংসারের অবস্থা কঠিন খারাপ স্যার। আমার স্যার এক লাখ টাকা ঋণ। তিনটা মেয়ে। এই লাইসেন্স নিয়ে যে হয়রানির মধ্যে পড়েছি স্যার, আমার লাইসেন্স জিরো হয়ে গেছে। অথচ আমরা সব কাগজপত্র আছে। অফিসের ইনাদের (কর্মকর্তাদের) সঙ্গে কথা বলা যায় না স্যার। বড় অফিসারদের সামনে সালাম দিয়ে দুইটাও কথা বলা যায় না; বলে যে বেরিয়ে যান।’ 

এ সময় অন্য চালক হেলপাররা হাততালি দিয়ে মমিনকে সমর্থন জানান। অভিযোগ আমলে নিয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান মমিনকে একদিনের মধ্যেই লাইসেন্স প্রদানের নির্দেশনা দেন।

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল কর্মপরিকল্পনা ২০২৩-২০২৪ এর আওতায় বিআরটিএ রাজশাহী সার্কেলের উদ্যোগে আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে চালক, হেলপার, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা অংশ নেন। এ সময় পরিবহন চালকদের বিভিন্ন সমস্যার কথা শোনেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান এবং তাৎক্ষণিকভাবে সেসব সমস্যার সমাধান দেন। তার সামনে মুহূর্তেই পরিবহন চালক ও মালিকদের অভিযোগের পাহাড় জমে যায়।

নিজের ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখিয়ে জনি নামের এক ট্রাকচালক বলেন, ‘স্যার, এই কার্ডটা আমি পেয়েছি ৬ আগস্ট। এখনও স্মার্টকার্ড পাইনি। এটা ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স। সার্জেন্টকে দেখালে বলে, এটা দিয়ে গাড়ি চালানো যাবে না। সার্জেন্টের সাথে কথা বলা যায় না স্যার। সার্জেন্ট বলে, যতটা কথা বলব, তত ২০০ টাকা করে জরিমানা বাড়বে। মামলা লাগিয়ে দেয়, তা না হলে রাস্তায় টাকা নেয়। রাস্তায় আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি স্যার।’ 

এ সময় বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার জানতে চান, কোন সার্জেন্ট ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকলেও মামলা দেন? উত্তরে জনি বলেন, ‘কেউই মানে না স্যার।’ চেয়ারম্যান বলেন, ‘এই ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স চালু করেই আমরা আইজিপিকি চিঠি দিয়েছি। সারাদেশের পুলিশ ইউনিটে চিঠি দিয়েছি যেন মামলা দেওয়া না হয়। এই কার্ডে কিউআর কোড আছে। সার্জেন্ট এটা যাচাই করতে পারবে। তারপরেও মামলা দায়ের করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। পরে তিনি রাজশাহী জেলা পুলিশের ট্রাফিক পরিদর্শককে ডেকে পাঠান। 

ট্রাফিকের পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন এসে জানান, ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স সম্পর্কে তিনি অবগত। কোনো সার্জেন্ট যদি এটা থাকার পরেও মামলা দেন, তাহলে সেটা ওই সার্জেন্টের অজ্ঞতা। এ সময় বিআরটিএ চেয়ারম্যান এই লাইসেন্সের বিষয়টি সব ট্রাফিক সার্জেন্টকে জানানোর নির্দেশনা দেন।

গণশুনানিতে আরও কয়েকজন চালক জানান, তারা ২০১৯ সালে লাইসেন্স করতে দিয়েছেন। কিন্তু এখনও লাইসেন্স পাননি। দুই-তিনমাস পর পর বিআরটিএ অফিসে আসেন। তখন হাতে লেখা লাইসেন্সের মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় ধরে তারা এই ভোগান্তির মধ্যে রয়েছেন। 

এ সময় বিআরটিএ চেয়ারম্যান এ সমস্যার কারণ জানতে চান। বিআরটিএর রাজশাহী সার্কেলের কর্মকর্তারা জানান, লাইসেন্স কার্ড প্রস্তুতের দায়িত্বে থাকা আগের প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটির কারণে রাজশাহীর প্রায় ৩৫০ জন চালক এমন দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন। 

তখন বিআরটিএ চেয়ারম্যান জানান, টাইগার আইটি কালো তালিকাভুক্ত হয়ে পরে আর কাজ পায়নি। তখন সারাদেশেরই কিছু ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাজ তারা শেষ করে যায়নি। কোনো ডাটাবেজও দিয়ে যায়নি। ফলে এই চালকদের লাইসেন্স দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে এবার তিনি উদ্যোগ নেবেন। আগের জমা দেওয়া টাকাতেই এই চালকদের নতুন করে লাইসেন্স দেওয়া হবে।

গণশুনানিতে রাজশাহী জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) সাবিহা সুলতানা, বিআরটিএ’র রাজশাহী সার্কেলের উপ-পরিচালক (ডিডি) এসএম কামরুল হাসান ও সহকারী পরিচালক (এডি) মোশাররফ হোসেনসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।