ভোটের মাঠে সংঘাত সহিংসতার শঙ্কা

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
ভোটের মাঠে সংঘাত সহিংসতার শঙ্কা

একদিকে বাড়ছে শীতের তীব্রতা; অন্যদিকে বাড়ছে নির্বাচনী উত্তাপ। অনেক এলাকায় প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল সোমবার প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই সারাদেশে বিভিন্ন দলের প্রার্থী-সমর্থকরা কোমর বেঁধে প্রচারে নেমেছেন। শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগ নেতারাই শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে নামায় ভোটের মাঠে সংঘাত-সহিংসতার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের বাইরের দল ও প্রভাবশালী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

পাবনা-২ আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) মনোনীত প্রার্থী ডলি সায়ন্তনীকে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে গতকাল অভিযোগ করেছেন তিনি। এ ঘটনায় সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা চেয়েছেন এ সংগীতশিল্পী। গত বৃহস্পতিবার রাতে নাটোর-৪ আসনের বর্তমান এমপি ও নৌকার প্রার্থী ডা. সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারীর অনুসারী রুবেল বালি তার বক্তৃতায় বলেন, নৌকার বিপক্ষে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে, তাকে নিশ্চিহ্ন করা হবে। যারা নৌকাবিরোধীদের পক্ষ নেবে, তাদেরও এলাকাছাড়া করা হবে। এছাড়া অভিযোগ উঠেছে ঢাকা-১৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠ থেকে সরে যাওয়ার জন্য এবং প্রচার না চালাতে নানা ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। তবে এ আসনে নৌকার প্রার্থী ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভয়ভীতি দেখাব, তেমন মানুষ আমি নই। আমি ৪০ বছর ধরে রাজনীতি করি। এর মধ্যে কেউ বলতে পারবে না, আমি কাউকে আঘাত করেছি, ধমক দিয়েছি। কারও ওপর জুলুম করেছি। আমার রাজনীতি মানুষের জন্য, কল্যাণের জন্য। নিজেকে সস্তা জনপ্রিয় করতে তারা (অভিযোগকারীরা) মিথ্যাচার করছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গোপন প্রতিবেদন বলছে, নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। যেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা হেভিওয়েট স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন, সেসব এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা তত বেশি।

গোয়েন্দাদের তথ্য বলছে, ফরিদপুর-৪ আসনে সংঘর্ষের শঙ্কা রয়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্যাহ নৌকার এবং বর্তমান সংসদ সদস্য যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নেমেছেন। এ আসনকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বরিশাল-৫ আসনে বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ আদালতের মাধ্যমে প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার পর নৌকার প্রার্থী পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সমর্থকদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এমন শতাধিক আসনে সংঘর্ষ হতে পারে বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার শঙ্কা।

গতকাল সোমবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের পরপরই মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী

অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হাজী মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লবের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৬ জন আহত হয়েছেন। গত ১১ ডিসেম্বর পিরোজপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে লালন ফকির নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন। তিনি ওই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের সমর্থক। গত রবিবার পিরোজপুরে সদর উপজেলার কদমতলা ও পৌর এলাকায় নৌকা ও স্বতন্ত্র এমপি প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে পৃথক সংঘর্ষে চার জন আহত হয়েছে। একই দিন নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলামের সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালামের সমর্থকদের সংঘর্ষে পাঁচজন আহত হয়। এ ঘটনায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর ১৪ কর্মী-সমর্থকের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া সংঘর্ষ হয়েছে রাজশাহী, বগুড়া, ফরিদপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায়।

পুলিশ সদর দপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) অপারেশন্স আনোয়ার হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, নির্বাচনে প্রার্থীরা যাতে নির্বিঘেœ প্রচার চালাতে পারেন, সে জন্য সদর দপ্তর থেকে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সবার সঙ্গে তো আর সার্বক্ষণিক পুলিশ মোতায়েন করা সম্ভব হবে না। কেউ যেন প্রতিপক্ষ প্রার্থী বা তার কর্মী-সমর্থকদের ওপর চড়াও হতে না পারে, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমরা প্রার্থীদের নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা নিচ্ছি। যে কোনো ধরনের সংঘর্ষ-সহিংসতা প্রতিরোধে টহল টিম বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া নির্বাচনে সন্ত্রাসী কর্মকা-সহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে যারা, তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান জোরদার করা হয়েছে।

নির্বাচনে সহিংসতা প্রতিরোধের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশ সদর দপ্তর সহিংসতা প্রতিরোধে পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছে। এ বিষয়ে প্রার্থীদের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তারা কথা বলছেন। তারা প্রার্থীদের ঝুঁকি ও নিরাপত্তার বিষয়ে তথ্য নিচ্ছেন। প্রার্থীদের চাহিদা ও গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। প্রার্থীদের নিরাপত্তা ও সহিংসতা প্রতিরোধে প্রতিটি জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হবে।

মুন্সীগঞ্জ ও নাটোরে নির্বাচনী সহিংসতায় আহত ১২

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে আরও দুটি জেলায় সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। জেলাগুলো হলো নাটোর ও মুন্সীগঞ্জ। নাটোর-১ আসনের বাগাতিপাড়ায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী শহিদুল ইসলাম এমপির সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক এমপি আবুল কালামের সমর্থকদের সংঘর্ষ ঘটে গত রবিবার রাত ৮টার দিকে। এতে ৫ জন আহত হন। গতকাল বেলা পৌনে তিনটার দিকে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের গজারিয়ায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস এমপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হাজী মোহাম্মদ ফয়সল বিপ্লবের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ৭ জন আহত হয়েছেন। উপজেলার গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের নতুন চরচাষী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় একটি দোকান ভাঙচুর করা হয়। আহতদের মধ্যে রয়েছেন- নৌকার সমর্থক গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের নতুন চরচাষী গ্রামের জাহাঙ্গীর, ইমন এবং বিপ্লবের সমর্থক, পুরান চরচাষী গ্রামের মোখলেস মিয়া, মহিউদ্দিন মোল্লা, মোশারফ হোসেন, নতুন চরচাষী গ্রামের নিজাম উদ্দিন ও হেলাল উদ্দিন।

এর আগের দিন পিরোজপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ আউয়াল ও নৌকার প্রার্থী শ ম রেজাউল করিমের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হন। একই দিন রাজশাহী-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এনামুল হকের অনুসারী এক নেতাকে হাতুড়িপেটা করে প্রতিপক্ষের কর্মীরা। পিরোজপুরের ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

-প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি গণ।