ভাগ্যবদল করা প্রথম গান এমন একটা মা দে না

তারেক আনন্দ
১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
ভাগ্যবদল করা প্রথম গান এমন একটা মা দে না

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যে কজন শিল্পীর হাত ধরে দেশে পপসংগীত জনপ্রিয়তা লাভ করে তার মধ্যে অন্যতম ফেরদৌস ওয়াহিদ। কিংবদন্তি এই পপস্টার তার পথচলার কথাগুলো বলেছেন প্রাণখুলে। লিখেছেন- তারেক আনন্দ

শুরু হলো আমার জীবনের নতুন এক অধ্যায়। রাতে প্র?্যাকটিসে চলে যেতাম। অনেক সুর ভাবছি মনে মনে। তখন গানের নতুন নতুন সুরে ডুবে থাকতাম। এর পর করতাম ক্ল্যাসিকেল চর্চা। ঘুমাতে ঘুমাতে রাত তিনটা, চারটা বেজে গেল। সকালবেলাই ক্রিং ক্রিং বেজে চলেছে। আমি তো ঘুমে। যখন ফোনটা ধরলাম। তখন ওপাশ থেকে কণ্ঠ ভেসে এলো, কী ফেরদৌস তুমি কি ঘুমাচ্ছ নাকি? আমি ধড়ফড় করে উঠলাম! আরে এ তো আমাদের স্যার। আবদুল্লাহ আবু সাঈদ স্যার। ওনার আমি ইন্টারমিডিয়েটে সরাসরি ছাত্র ছিলাম। এর পর তিনি বললেন, ফেরদৌস তুমি আজ সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে অবশ্যই দেখা করবে, তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আমি একদিকে খুশি, অন্যদিকে টেনশন। স্যার আমাকে কেন ডাকল? এই ভাবতে ভাবতে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা চলে এলো। কিসের খাওয়া, কিসের গোসল।

সন্ধ্যার পর চলে গেলাম। স্যারের বাসা আমার বাসা থেকে কাছেই, দশ মিনিট হাঁটতেই চলে গেলাম। তিনতলায় উঠলাম। স্যারের ঘর খোলাই ছিল। ভেতরে আরও দু-চারজন বসা। আমাকে দেখেই স্যার বললেন, আরে ফেরদৌস আসো আসো, তোমার জন্যই বসে আছি। স্যার বলল, কেমন আছ চা খাও আগে। আমি বললাম, অসুবিধা নেই বলেন। আরে তুমি খাও, জমিয়ে কথা বলব। এমনিভাবে বেশ কিছুক্ষণ পর বলল, আমি একটি অনুষ্ঠান করছি বিটিভিতে। তখন তো টিভি একটি। আজকের মতো টেলিভিশিনের সমাহার ছিল না। সবেধন নীলমণি ওই বিটিভিই। ওটিই আমাদের জন্য মাথার মুকুট। বিটিভি ঘিরে আমরাও বড় হয়েছি। বিটিভির কাছে আমরা সন্তানের মতো। বিটিভির প্রতি মায়া আমার এখনো জাগে।

স্যার বলল, আমি একটি অনুষ্ঠান করছি নাম ‘সপ্তবর্ণা’। এটিতে একটি গানের প্রতিযোগিতা থাকবে। একদিকে তিন-চারজন, অন্যদিকে তিন-চারজন। এক পক্ষ গান ধরবে, গেয়ে ছেড়ে দেবে। অন্য পক্ষ শেষ অক্ষর থেকে অন্য গান শুরু করবে। এভাবে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে হারাবে। যারা জিতবে তারা চলে যাবে ফাইনাল রাউন্ডে। চমৎকারভাবে আমার মাথায় ঢুকে গেল। তিনি আরও বললেন, তোমার বন্ধুবান্ধব জোগাড় করো, নামকরা শিল্পীদের দিয়ে প্রোগ্রামটা করতে চাই, তুমি সাজিয়ে নিয়ে এসো। এর পর আমি যথারীতি ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ, শম্পা রেজা, কাজী হাবলুসহ আমাদের নিজস্ব বন্ধুরাই চলে এলো। এর মধ্যে আজম খানকে পাওয়া যায়নি। পরদিন সন্ধ্যায় লিস্ট নিয়ে চলে গেলাম। স্যার দেখে তো মহাখুশি।

স্যারের সান্নিধ্য পাওয়ার পর আমি আর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছিলাম না। গত রাত থেকেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, স্যারকে আমার বলতেই হবে যে, আমার একটা গান রেকর্ড করে রেখেছি। গানটা প্রচারের সুযোগ পাচ্ছিলাম না। বিটিভিতে গানটা যদি একবার প্রচার হয় তা হলে সোনায় সোহাগা!

এই গানটি নিয়ে ব্যাপক প্রচারের চিন্তাভাবনা করছিলাম, মনে মনে ভাবছিলাম আর কি! কীভাবে করব, কাউকে তো চিনি না। ভাগ্যের কী পরিণাম, স্রষ্টা আমাকে সুযোগ করে দিলেন। আমার পরিকল্পনা ছিল, স্যারকে আমি যেভাবেই হোক রাজি করাব করাবই।

স্যারকে বললাম, স্যার আমার একটি ছোট্ট আবদার আছে। বলো কী? আমি একটি গান করতে চাই টিভিতে, তবে এটা আমি সরাসরি গাইব না, ঠোঁট মেলাব। এটা কেমন?

বললাম, মিউজিক চলবে আর আমি ঠোঁট মিলিয়ে যাব। এটা হবে? অবশ্যই। আমি করেছি এর আগে বাইরে। স্যার বললেন, আগে গানটা শোনাও আমাকে।

তার আগে বলে রাখি বিটিভিতে এটাই ছিল প্রথম লিপসিং করা গান। স্যারকে গানটা শোনালাম। গান শুনেই স্যার বললেন, দেখো গান তো যাবেই, তার আগে তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, এই গানটা আজকে যদি মানুষের পছন্দের তালিকায় চলে আসে তা হলে বিশ বছর পরও একইভাবে মানুষ শুনবে। স্যারের কথাটি আমার কানে এখনো বাজে। সবকিছু অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে গেল। আমাদের প্রোগ্রামের দিন। স্যার বলল, আমাদের আজকের অনুষ্ঠানে একটি গান হবে। গানটি গাইবেন ফেরদৌস ওয়াহিদ। নতুন একটি গান নিয়ে আসছে। আমি গাইলাম।

পরদিন সকাল। রিকশা নিয়ে বের হলাম। দেখি অনেকে আমার দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে! আঙুল দেখিয়ে নিশ্চয়ই কিছু বলছে- এই ছেলেটাকেই দেখলাম কাল গান গাইতে! কিছু একটা হবে। দিন যত যায়, ততই বুঝি গানটি অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করছে। জীবনের সেই সময় আমার মনে হচ্ছিল, আমি কি হিরো হয়ে গেলাম, আমি কি এতই ভাগ্যবান! এ-ও কি সম্ভব! চারদিকে আমাকে নিয়ে হইচই পড়ে গেল। সেই গানটি হলো ফেরদৌস ওয়াহিদের ‘এমন একটা মা দে না’।

আমার ভাগ্যবদল করা প্রথম গান। আসতে লাগল প্রচুর অনুষ্ঠান। একের পর এক নতুন গান করছি। আমাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেল। ফিরোজ সাঁই আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, কিরে তোর গান তো হিট করেছে। গানটি লেখেন ডা. নাসির আহমেদ অপু। সুরও তার করা। এ গানটি রেকর্ড হয় ইপসা স্টুডিওতে। রিদম প্রোগ্রামিং করেছিলেন কাজী হাবলু। সেই স্পন্দনের দিনগুলো আমার খুব মনে পড়ে। অবিস্মরণীয় সেই সময়। এটি ভোলার নয়। জীবনের নতুন এই প্রান্তিকে এসে মনে হলো, আমি যেন নতুন একটি জাহাজে বিশাল সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছি।

‘এমন একটা মা দে না, এমন একটা মা দে না, যে মায়ের সন্তানেরা কান্দে আবার হাসতে জানে...।’

গানটি প্রকাশ হয়েছে ১৯৭৬ সালে। ‘সপ্তবর্ণা’ অনুষ্ঠানে। সাদাকালো যুগে সে সময় তিন লাখ দর্শক ছিল।