এখনো বিশ্বাস করি নির্বাচন হবে না
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচন অনেকটা একতরফাভাবেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব) অলি আহমেদ বীরবিক্রম। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, শেষ পর্যন্ত একতরফাভাবে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে দীর্ঘমেয়াদে গভীর সংকটে পড়বে। তিনি বলেন, এখনো বিশ্বাস করি, এ নির্বাচন হবে না। গত বৃহস্পতিবার মহাখালীর নিজ বাসায় দৈনিক আমাদের সময়ের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ এ আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত হন অলি আহমেদ। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি গঠনেও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পাশে থেকে বিশেষ অবদান রাখেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও খালেদা জিয়ার পাশে থেকে রাজপথে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। বিএনপি সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। ২০০৬ সালে বিএনপি ছেড়ে এলডিপি নামে নতুন দল গঠন করেন। বর্তমানে এলডিপি যুগপৎ ধারায় বিএনপির সঙ্গে সরকারের পদত্যাগসহ একদফা এবং একতরফা তফসিল বাতিলের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে।
অলি আহমেদ তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি এবং অর্থনীতি, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের ভোট বর্জন ও তাদের আন্দোলনসহ নানা প্রসঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন।
৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে অলি আহমেদ বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে এক কথায় বলতে গেলে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সাধারণ ভোটারদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। এখানে ৩শ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ তাদের শরিকদের মধ্যে হয়তো ৩০-৪০টি আসন বণ্টন করে দেবে। অবশিষ্ট আসন তাদের প্রার্থীদের জন্য রাখবে।’
এলডিপির প্রেসিডেন্ট বলেন, পারিপাশ্বিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যাবে, কে কোন আসন থেকে নির্বাচিত হবেন তা-ও ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্ধারিত হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে সাধারণ ভোটারদের কোনো অংশগ্রহণ ও তাদের মতামতও থাকবে না। এটা কোনো নির্বাচন নয়, ভাগাভাগির ছেলেখেলা। নির্বাচন কমিশন শুধু আওয়ামী লীগের নির্দিষ্ট করা প্রার্থীদের নাম বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করবে। ইসির হাতেও কোনো ক্ষমতা নেই। এ নির্বাচনকে কোনো অবস্থায় অংশগ্রহণমূলক বলা যাবে না। এটা একটি একতরফা নির্বাচন।
এই একতরফা নির্বাচন জাতিকে গভীর সংকটে ফেলবে বলে মনে করেন অলি আহমেদ। তিনি বলেন, একতরফা এই নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেশ এবং দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতি আরও গভীর সংকটে পড়বে। ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের খোঁড়া গর্ত বলে মনে করেন তিনি। বলেন, এ গর্তে তারা নিজেরাই নিপতিত হবে। পরিস্থিতি এমন হবে, তাদের ছেলেমেয়ে পরিবার-পরিজনও সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারবে না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির আসন সমঝোতার জটিলতা এবং জাতীয় পার্টিকে নিয়ে নানা গুঞ্জন নিয়ে অলি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি সম্পর্কে অনেক গুঞ্জন শোনা যায়। তাদের সম্পর্কে আগাম কোনো মন্তব্য করা খুব কঠিন। তারা কখন কী ঘটায়, তা বলা খুবই দুষ্কর।
তফসিল অনুযায়ী ১৮ ডিসেম্বর প্রার্থীদের মাঝে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে- এ বিষয়ে অলি আহমেদ বলেন, ‘৭ জানুয়ারি নির্বাচন হবে; এখনো আমি বিশ্বাস করি না।’ এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং অপরাপর বড় বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করছে। ভোট বর্জনকারী এসব দল ভোটারদের ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে। আমিও মনে করি, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখা এবং দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষায় ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত থাকা উচিত। এ সরকারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে।’
৭ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন হলে সেখানে সরকার ও বিরোধী দলে কারা থাকবে তা জাতির কাছে স্পষ্ট বলেও মনে করেন অলি আহমেদ। তিনি বলেন, এখানে নির্বাচন হচ্ছে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ। সেখানে তারাই সরকার গঠন করবে। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দল হবে সরকারের কিছু গৃহপালিত; যাদের তারা টাকাপয়সা দিয়ে কিনে নিয়েছে।’
আরও পড়ুন:
গণভবনে ডাক পেলেন আ. লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা
দেশের চলমান সংকট উত্তরণে জনগণ এবং বন্ধুরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিশে^র কাছে নিজের বিশেষ আবেদন তুলে ধরেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশবাসীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আশা করি, জনগণ দেশের প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করবেন এবং নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবেন না। এখনই সময়, সব দেশপ্রেমিক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যুব সমাজের প্রতি আহ্বান থাকবে, একদলীয় আওয়ামী বাকশালীদের অবসান ঘটিয়ে দেশকে রক্তপাত ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করা। অন্যথায় আমাদের সবাইকে কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হবে, যা হবে খুবই ভয়ানক। এ ছাড়াও আল্লাহর কাছেও আমাদের সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে। সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকলেই কেবল মানুষের জীবনে সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য এবং মুক্তি আসবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে কোন দেশের গুরুত্ব কতটুকু সে বিষয়ে বলতে গিয়ে কর্নেল (অব) অলি বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত অধিকাংশ দেশের ওপর নির্ভরশীল। এসব দেশে আমাদের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি। অন্যদিকে, বাংলাদেশ হচ্ছে ভারত ও চীনের বড় বাজার। এসব দেশ কিন্তু আমাদের থেকে তেমন কিছু আমদানি করে না। শুধু বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা করাতে বছরে যায় দেড় কোটির বেশি মানুষ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তারা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তিনি প্রত্যাশা করেন, কোনো ব্যক্তি বা দলকে সমর্থন না দিয়ে একইভাবে চীন এবং ভারতেরও উচিত হবে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন করা। তিনি বলেন, দেশের মানুষের মাঝে একদিন না একদিন দেশাত্মবোধ জেগে উঠবে। আমি কোনো দেশ বা দলের অমঙ্গল কামনা করি না। অনুরূপভাবে আমি মনে করি, কোনো দেশও যেন আমাদের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজে অংশগ্রহণ না করে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতেও অলি আহমেদ চলমান আন্দোলনের সফলতা দেখতে পান। তিনি বলেন, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে গায়েবি মদদ আসবেই; কেউ না কেউ দেশের এই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াবে এবং জনগণের বিজয় হবে। ঘৃণা বা প্রতিশোধ নয়, ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ ভোটবর্জনকারী সব দলকে নিয়ে একমঞ্চে আন্দোলন করা প্রসঙ্গে এলডিপি প্রেসিডেন্ট অলি আহমেদ বলেন, ভবিষ্যতে সব দলের শক্তি যদি এক জায়গায় হয়, এতে আন্দোলন আরও শক্তিশালী ও বেগবান হবে। সরকার পতনের আন্দোলন ত্বরান্বিত হবে। আমাদের মূল ঐক্য হওয়া উচিত আওয়ামী বাকশালীদের পতন। এই ঐক্য গড়তে যদি নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা শর্তারোপ করা হয়, তা হলে পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগকেই সাহায্য করা হবে।