জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার আহ্বান
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে নতুন একটি চুক্তির মধ্য দিয়ে শেষ হলো জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮। চুক্তিতে প্রথমবারের মতো কঠোর ভাষায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে সরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে পর্যায়ক্রমে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধের কথা না বলে স্পষ্টভাবে সরে আসার আহ্বান জানানো হয়। চুক্তিতে প্রথমবারের মতো তেল, গ্যাস ও কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার জন্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কয়েক দিনের আলোচনার পর সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলো শেষ পর্যন্ত নতুন এই সমঝোতায় উপনীত হলো, যাতে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসতে সব দেশকে ভূমিকা রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে অনেক দেশের দাবি অনুযায়ী একবারেই বাতিল না করে ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে নতুন চুক্তিতে।
এদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলমান কপ-২৮ জলবায়ু সম্মেলনে পরবর্তী আয়োজক দেশ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে এশিয়া মহাদেশের আজারবাইজান। গত সোমবার পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলন কপ ২৯-এর স্বাগতিক দেশ আজারবাইজানের নাম ঘোষণা করা হয়। জানা যায়, আজারবাইজানে দীর্ঘ এক মাস অচলাবস্থার পর পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। জলবায়ু সম্মেলনের পরবর্তী আয়োজক হতে পশ্চিম ইউরোপের সমর্থন পেয়েছে দেশটি।
কপ-২৮ সম্মেলনে অবশ্য এটি সবাই মেনে নিয়েছে যে ভবিষ্যতে গ্যাসের নিঃসরণ আরও বাড়বে, যদিও উন্নত কিংবা অনুন্নত দেশভেদে এর মধ্যে পার্থক্য থাকবে। কপ ২৮-এর প্রেসিডেন্ট বলেছেন দেশগুলো বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করেছে এবং বিশ্বকে একটি সঠিক পথের নির্দেশনা দিয়েছে।
কপ-২৮ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তহবিল আদায়ে নিয়েছে শক্ত অবস্থান। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, তাপপ্রবাহসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে গেছে। এসব দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে জরুরি ভিত্তিতে সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
সম্মেলনে রাশিয়ার প্রতিনিধি চুক্তিকে উচ্চাভিলাষী আখ্যায়িত করলেও এর প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রতিটি পক্ষই তাদের পছন্দনীয় বাস্তবসম্মত উপায় বেছে নিতে পারে। যুক্তরাজ্যের জলবায়ুমন্ত্রী গ্রাহাম স্টুয়ার্ট বলেছেন জীবাশ্ম জ্বালানি যুগের অবসান শুরু হলো। আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ। অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ুমন্ত্রী ক্রিস বোয়েন চুক্তিকে ‘শক্তিশালী ফল’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন দুবাইয়ের আলোচনা হলো একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক’। এর আগে চুক্তির বিষয়বস্তু নিয়ে অংশ নেওয়া দেশগুলো একমত না হওয়ায় আলোচনা বাড়তি সময়ে গড়িয়েছিল। তবে বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, এই সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই।
এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বিশ্বের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক মন্দার এক পটভূমির মধ্যেই এই জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে এর প্রতি দৃষ্টি কম ছিল। একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রুখতে তৈরি করা তহবিলগুলোতে দিন দিন অর্থ সংস্থান কমে যাওয়ার কারণে এর থেকে খুব বেশি প্রত্যাশাও ছিল না। নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস্পেন বার্থ আইদা বলেছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে এই প্রথম পরিষ্কার একটি প্রস্তাবনাকে ঘিরে বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এটি একটি স্পষ্ট সমস্যা হয়ে ছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা এর মোকাবেলা করতে পেরেছি।
রয়টার্স জানায়, তেল, গ্যাস ও কয়লার ব্যবহার ‘ধাপে ধাপে বন্ধ করার’ বিষয়ে কপ-২৮ এর চুক্তিতে কঠোর ভাষা ব্যবহার করার জন্য শতাধিক দেশ ব্যাপক তদবির করেছিল, কিন্তু সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন তেল রপ্তানিকারী দেশগুলোর জোট ওপেকের তীব্র বিরোধিতার মুখে তারা ছাড় দিতে বাধ্য হয়। বিশ্ব নির্দিষ্ট জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা ছাড়াই দূষণ কমাতে পারে বলে যুক্তি ওপেকের।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
মঙ্গলবার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এই নিয়ে তর্কবিতর্ক চলতে থাকায় সম্মেলন গতকাল বুধবারের বাড়তি সময়ে গড়ায়। অবশেষে বিষয়টি নিয়ে একটি চুক্তি সম্ভব হয়। এখন দেশগুলোর জাতীয় নীতি ও বিনিয়োগে চুক্তিতে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো প্রয়োগের পালা।
দুটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের মধ্য দিয়ে এই সম্মেলন শেষ হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি তহবিল ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ (জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতি তহবিল) গঠনের পরই সেখানে ৭০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মূল্যায়ন (জিএসটি) প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়েছে গত সোমবার। কপ-২৮ সম্মেলনে অংশ নেওয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি দল জানিয়েছে, শিল্পোন্নত দেশগুলো যাতে জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতি তহবিলে অন্য কোনো খাত থেকে অর্থ এনে না দেয় এই আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ জিসিএফ ও অভিযোজন তহবিলে অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে নতুন তহবিলে বরাদ্দ না দেয়, সে ব্যপারে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করা হয়েছে।