সহিংসতায় পাহাড়ে পর্যটনে ভাটা
বান্দরবান সদর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে মুনলাইপাড়া চান্দের গাড়ি করে যেতে দুই ঘণ্টা লাগে। রুমা উপজেলা সদর থেকে লাগে মাত্র ১০ মিনিট, দূরত্ব সাড়ে চার কিলোমিটারের মতো। শঙ্খ নদীর পারে অবস্থিত ছবির মতো এই গ্রামটি পরিচ্ছন্নতা আর মানুষের আচরণের কারণে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই খ্যাতির জন্য বগা লেক কিংবা কেওক্রাডং দেখতে আসা-যাওয়ার পথে প্রতিদিন এখানে রাতযাপন করতেন গড়ে ৪০ জন পর্যটক। সেই মুনলাইপাড়া এখন পর্যটকশূন্য। অথচ আগে প্রত্যেক পর্যটক রাতযাপনের জন্য এখানে কটেজে ৪৫০ টাকা পরিশোধ করতেন।
বান্দরবানে বম সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ও মগ পার্টির কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ার পর থেকে মূলত পর্যটকরা ওই পথে আসা-যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। বেস ক্যাম্প নামের রাজধানীকেন্দ্রিক একটি সংগঠন মূলত মুনলাইপাড়ায় পর্যটক আসা ও তাদের রাতযাপনের ব্যবস্থাপনা দেখভাল করত। সংগঠনটি এখন আর মুনলাইপাড়ার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে না বলে জানালেন মুনলাইপাড়ার কারবারি লিয়ান অং বমের ছেলে আনুয়াম বম।
প্রতিবছর বর্ষার শুরু থেকেই কাপ্তাই হ্রদকে ঘিরে রাঙামাটিতে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ে। শরৎকাল থেকে বাড়ে বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে। তবে রাঙামাটিতেও একই সময়ে পর্যটকদের আসা-যাওয়া থাকে সমানে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে নতুন করে সহিংসতা ছড়ানোর কারণে পর্যটকরা তাদের নির্ভয়ে যাওয়ার পথে হোঁচট খেয়েছেন। তাই ভর মৌসুমেও বান্দরবান এখন বলতে গেলে পর্যটকশূন্য। নভেম্বরের আগে কয়েক মাস প্রশাসনের পক্ষ থেকেই বান্দরবানে পর্যটক আসা নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। গত ৫ নভেম্বর কুকি চিনের সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বৈঠকের পর সংঘাত বন্ধ হয়েছে। কিন্তু পর্যটকরা আর ফেরেননি।
মুনলাইপাড়া থেকে বগা লেক যেতে লাগে ৪০ মিনিট লাগে। সেখান থেকে কেওক্রাডং আরও ৪০ মিনিটের মতো। বগা লেকের পাড়ে পর্যটক থাকার জন্য কটেজ আছে। একইভাবে কেওক্রাডংয়ের চূড়ার আশপাশেও আছে চারটি কটেজ। বর্তমানে সেখানে কোনো পর্যটক নেই। এমনকি বান্দরবান শহরের অর্ধশত হোটেল ও কটেজ পর্যটক ক্ষুধায় ভুগছে।
বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি লাল জারলাউম বম আমাদের সময়কে বলেন, বম বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিনের কার্যক্রমের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বম জাতিগোষ্ঠী। তাদের সশস্ত্র কার্যক্রমের পর ৯টি গ্রাম পুরোপুরি জনশূন্য। এপ্রিলে জুম শুরু হয়। বম জাতিগোষ্ঠী জুম চাষের সুযোগ পায়নি। বর্তমানে সবাই খাদ্য সংকটে ভুগছে। একমাত্র কেপলাপাড়ার মানুষ ঘরে ফিরতে পেরেছে। তারা খুব খুশি। তিনি বলেন, আমরা আবারও প্রশাসনের সঙ্গে কুকি চিনের সংলাপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
তবে বান্দরবান ট্যুরিস্ট পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনজুর মোরশেদ আমাদের সময়কে বলেন, সেই ভয়ের পরিস্থিতি এখন নেই। পর্যটকরা চাইলেই আসতে পারছে। আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছি। তিনি বলেন, শান্তি চুক্তির আগে একজন পর্যটক হিসেবে আমরা পাহাড়ে আসতে সাহস করতাম না। এখন থানচির মতো জায়গায় রিসোর্ট আছে। সেখানে সশরীরে গেলে সব বোঝা যাবে। মনজুর মোরশেদ বলেন, পর্যটনের জন্য কিছু সমস্যাও আছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর সময়টা কীভাবে কাটাবে সেই সমস্যা এখানে আছে। পাহাড়ে সন্ধ্যার পর যাওয়ার মতো জায়গা নেই। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা এখানকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্টির লোকজনকে তাদের সংস্কৃতি তুলে ধরার জন্য উৎসাহিত করছি। তাদের প্রশিক্ষণের পরিকল্পনাও আছে আমাদের। এখন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ এটা বুঝতে পেরেছে যে, পর্যটক এলে তাদেরই সবচেয়ে বেশি লাভ। পাহাড়ে পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করা লোকজনের বড় অংশই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাহাড় বান্দরবানে। এখানে মানুষ আসে পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে। আর রাঙামাটিতে পর্যটকের জন্য আছে কাপ্তাই হ্রদের মায়া। খাগড়াছড়ির পর্যটকদের একটি বড় অংশই ঘুরতে যান সাজেক।
বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বলেন, আমরা নানাভাবে পর্যটনকে উৎসাহিত করছি। এখানে মানুষ পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসে ঝুঁকি নিয়ে অনেক ভেতরে চলে যান। আমরা তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছি।