পাকবাহিনীর পালানোর সব পথ বন্ধ

সৈয়দ রিফাত
১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
পাকবাহিনীর পালানোর সব পথ বন্ধ

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১। মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্য তখন ঢাকা মুক্ত করা। দেশের বেশির ভাগ অঞ্চল থেকে পালাতে শুরু করে পাক হানাদার বাহিনী। তবে প্রায় সব পয়েন্টেই

পলায়নরত পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর বাধার সম্মুখীন হয়। উপায় না পেয়ে নৌপথে নিরপেক্ষ দেশের পতাকা উড়িয়ে জাহাজ নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে পাক হানাদার বাহিনী। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে এদিন ভারতকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার পরামর্শ দেয় চীন।

মাহমুদ হাসানের লেখা ‘দিনপঞ্জি একাত্তর’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাকবাহিনীর পালানোর সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। সম্মিলিতবাহিনী উত্তরবঙ্গে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের ঢাকায় যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়। যশোর পতনের পর পাকবাহিনী মাগুরা হয়ে ফরিদপুরের দিকে পালাতে থাকে। শত্রুবাহিনীর ১০৭ নম্বর পদাতিক ব্রিগেড খুলনার দিকে পালাতে থাকে। তবে যৌথবাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করে। কুষ্টিয়ায় যৌথবাহিনী শত্রুর ওপর আক্রমণ চালালে তারা অবস্থান ছেড়ে নাটোর ও পাবনার দিকে পালিয়ে যায়। পালানোর সময় পাক হানাদার বাহিনী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংস করে।

এদিন উত্তর-পশ্চিম সেক্টরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি পলাশবাড়ী যৌথবাহিনীর দখলে এলে রংপুর ও দিনাজপুরে অবস্থান করা পাক হানাদার বাহিনী বগুড়া ও রাজশাহী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সড়কপথে পালানোর পথ বন্ধ হয়ে গেলে তারা রেলপথে ঢাকা যাওয়ার উপায় খুঁজতে থাকে। এদিন রাতে পাকিস্তানি বাহিনী জামালপুর গ্যারিসন ছেড়ে ঢাকার দিকে পালানোর সময় শহরের অদূরে যৌথবাহিনীর বাধার মুখে পড়ে। এদিন নোয়াখালী শহর শত্রুমুক্ত হয়; চট্টগ্রামের দিকে এগোতে থাকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী। যৌথবাহিনীর অন্য দল খুলনার ১৬ মাইল দূরে পৌঁছলে পাকিস্তানি বাহিনীর পালানোর পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। ময়মনসিংহে যৌথবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আঘাত হানে। পাকিস্তানি সেনারা টাঙ্গাইলের ভেতর দিয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে পাকিস্তানি সেনারা ভৈরব সেতুর অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলো বারবার ঢাকার চারদিকে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটি এবং সাভার ও নয়ারহাটে রেডিওর ট্রান্সমিটারের ওপর হামলা চালায়। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর নৌ ইউনিট ও ভারতীয় নৌবাহিনী এদিন যৌথভাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর চালনা মুক্ত করে। এর আগে ভারতীয় বাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে। কয়েকটি পাকিস্তানি জাহাজ বঙ্গোপসাগরে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে। খুলনায় রূপসা নদীতে ভয়াবহ নৌযুদ্ধে শত্রুর মোকাবিলা করে এদিন শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন।

১১ ডিসেম্বরের ভারতীয় সংবাদপত্র দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার এক সংবাদ থেকে জানা যায় নাস্তানাবুদ পাকবাহিনীর হাহাকারের কথা। ‘ঢাকা থেকে হাহাকার, জলদি! জলদি!’ শিরোনামের ওই খবরে বলা হয়, পূর্ববঙ্গ সরকারের চিফ সেক্রেটারি রাওয়ালপিন্ডিকে জানান, যা করার জলদি সারো। আর সময় নেই। জবাবে রাওয়ালপিন্ডি থেকে জবাব আসেÑ ‘ঘাবড়াও মাত’। পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদাররা বাংলাদেশকে মেধাশূণ্য করার পরিকল্পনা করে। এদিনই ঢাকায় রাও ফরমান আলির নেতৃত্বে ও পরিকল্পনায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সূচনা হয়। শান্তিনগরের চামেলীবাগের ভাড়াবাড়ি থেকে প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার এক খবর থেকে জানা যায়, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভারতকে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার পরামর্শ দেয় চীন। অন্যথায় ভারতকে লজ্জাজনক পরাজয়ের ফাঁকা হুশিয়ারি দেয় তারা। এদিন অস্ট্রেলিয়া রেডিওর এক খবরে জানানো হয়Ñ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তিনশর বেশি বিদেশি ও ৩৭৩ পাকিস্তানি কর্মচারী আছেন। খবরে বলা হয়Ñ তারা সবাই উৎকণ্ঠিত থাকলেও সেখানকার পরিবেশ ছিল আশ্চর্য রকম স্বাভাবিক।