মুক্তিবাহিনীর অলআউট অ্যাকশন
১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর। একদিকে মিত্রবাহিনীর সামনে শুধুই ঢাকা দখলের লড়াই। সবদিকে দিয়ে মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অন্যদিকে ৯ মাসের গেরিলা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে মুক্তিবাহিনী মাঠে নামে অলআউট অ্যাকশনে। বাইরে থেকে হানাদার বাহিনীর প্রবেশ রুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে একের পর এক জনপদ মুক্ত হতে থাকে।
এদিন ভারতীয় সংবাদপত্র দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘মুক্তি সংগ্রাম ঢাকার দ্বারপ্রান্তে’। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই এখন বাংলার রাজধানীর দ্বারপ্রান্তে চর্তুদিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিসেনারা ঢাকার দিকে এগোচ্ছেন। মাঝে কয়েকটা নদী পদ্মা আর মেঘনার শাখা-প্রশাখা। তারপরেই ঢাকার লড়াই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াই। একই দিনের অন্য এক খবরে জানা যায় পাক নৌশক্তির ভরাডুবির খবর। এদিন সলীল সমাধি হয় পাকিস্তানি সাবমেরিন গাজীর। নয়াদিল্লির এক খবরে জানানো হয় ডিসেম্বরের ৯ তারিখ পর্যন্ত ৭৩টি পাকিস্তানি বিমান ধ্বংসের খবর। এ ছাড়া পাকিস্তানের তিনটি রণতরী, ৯টি গানবোর্ট এবং দুটি পাকিস্তানি সাবমেরিন ধ্বংসের খবর পাওয়া যায়। ৯ ডিসেম্বর যশোরের
পথে পথে ছিল জয় বাংলা ধ্বনি। পরিমল ভট্টাচার্যের লেখা ওইদিনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ দিন যশোরের পথে প্রান্তরে, দোকানে, বাড়িতে এবং গাছের ডালে ডালে ঝোলানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। হানাদান বাহিনীর অত্যাচারে ঘর ছাড়া ওই অঞ্চলের মানুষরা এদিন মালবোঝাই রিকশা আর গরুর গাড়িতে নিজ আবাসে ফিরতে শুরু করেন। একাত্তরের এইদিনে শত্রুমুক্ত হয় কুমিল্লার দাউদকান্দি, গাইবান্ধা, কপিলমুনি, ত্রিশাল, নকলা, ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোনা, পাইকগাছা, কুমারখালী, শ্রীপুর, অভয়নগর, পূর্বধলা, চট্টগ্রামের নাজিরহাটসহ বিভিন্ন এলাকা। চুয়াডাঙ্গা ও চাঁদপুর শহরে এদিন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। যৌথবাহিনী ঘিরে রাখে জামালপুর।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
মাহমুদ হাসানের লেখা ‘দিনপঞ্জি একাত্তর’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এদিন নয়াদিল্লিতে ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র বলেন, পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ বিরতির প্রশ্নটি অবশ্যই একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে। কেননা সেখানে বাংলাদেশ সরকারকেই আমরা একমাত্র আইন সঙ্গত সরকার বলে স্বীকার করি। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এবং এএফপির খবরে জানানো হয়, করাচিতে অবস্থান করা বিদেশিরা এদিন করাচি ত্যাগ করে। এদিন দিল্লিতে উদ্বোধন করা হয় বাংলাদেশ মিশনের। উদ্বোধনকালে মিশনপ্রধান হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী বলেন, কয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকা মুক্ত হবে।
জানা যায়, বাংলাদেশের জনগণের হাতে ধরা পড়া পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এদিন বাংলাদেশ সরকার নির্দেশ দেয়। নির্দেশে বলা হয়, ধৃত পাকিস্তানিদের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করা হবে এবং পাকিস্তান থেকে পাঁচ লাখ বাঙালিকে নিরাপদে স্বদেশে ফিরিয়ে আনতে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে। মুজিবনগরে এদিন সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনের কার্যক্রম শুরু এবং খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
বাংলাদেশ সরকার এদিন সেনানিবাস বাদে মুক্ত কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেসামরিক প্রশাসনব্যবস্থা চালু করে। ৯ মাস পর সেখানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে আসে। বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে কুমিল্লায় এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গত ৯ মাস যারা পাকিস্তানি বেয়নেটের মুখে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন, তারা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। মুক্তিবাহিনী পুলিশের দায়িত্ব নেয়।