মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় গল্প

বিনোদন সময় প্রতিবেদক
০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় গল্প

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের মহত্তম অধ্যায়। দীর্ঘ ৯ মাস পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সংগ্রাম আর লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের বিজয় ও স্বাধীনতা। টিভি নাটকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় গল্পের কথা উঠে এসেছে যুগে যুগে, বিভিন্নভাবে। তবে বর্তমানে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বাড়লেও বিজয় দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবসে নামমাত্র একটি নতুন কিংবা পুরনো নাটক প্রচার করা হচ্ছে। অন্যদিকে ইউটিউব কিংবা ওয়েব প্ল্যাটফর্মে মুক্তিযুদ্ধের নাটকের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। কারও কারও অভিমত, অনেক নির্মাতার নির্মাণের আগ্রহ থাকার পরও চ্যানেল কর্তৃপক্ষের অনিচ্ছার কারণে তারা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক নির্মাণ করছেন না। অথচ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম নাটকটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, নাম ‘বাংলা আমার বাংলা’। ড. ইনামুল হকের লেখা এ নাটকটি নির্মাণ করেছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। ১৯৭২-এর মধ্যবর্তী সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত একটি আলোচিত মুক্তিযুদ্ধের নাটক ‘জনতার কাছে আমি’। কাছাকাছি সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাটক ‘এরা ছিল এধারে’। মোর্শেদ চৌধুরী রচিত এ নাটকটি প্রযোজনা করেন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ। সত্তরের দশকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত আরও কয়েকটি নাটক জনপ্রিয়তা পায়। এর মধ্যে রয়েছেÑ নাজমা জেসমিন চৌধুরীর লেখা ও আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমামের প্রযোজনায় ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, জিয়া আনসারীর ‘কোনো এক কুলসুম’, আতিকুল হক চৌধুরীর ‘কম্পাস’, রাবেয়া খাতুনের ‘বাগানের নাম মালনীছড়া’, জোবেদ খানের ‘একটি ফুলের স্বপ্ন’, রাজিয়া মজিদের ‘জ্যোৎস্নার শূন্য মাঠ’।

আশির দশকেও মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে নির্মিত হয় একাধিক নাটক। প্রতিকূল পরিবেশ, কারিগরি সীমাবদ্ধতা ও কড়া নীতিমালার মধ্যেও প্রযোজকরা অসাধারণ কিছু নাটক নির্মাণ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যÑ আল মনসুর রচিত ও মুস্তাফিজুর রহমান প্রযোজিত ‘নয়ন সম্মুখে তুমি নাই’, মমতাজউদদীন আহমেদ রচিত ও মোস্তফা কামাল সৈয়দ প্রযোজিত ‘এই সেই কণ্ঠস্বর’, হাবিবুল হাসানের রচিত ও আবদুল্লাহ আল মামুন প্রযোজিত ‘আমার দ্যাশের লাগি’, কাজী মাহমুদুর রহমান রচিত ও মুস্তাফিজুর রহমান প্রযোজিত ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’, মমতাজউদদীন আহমেদ রচিত ও আবদুল্লাহ আল মামুন প্রযোজিত ‘একটি যুদ্ধ এবং অন্য একটি মেয়ে’, মামুনুর রশীদ রচিত ও মুস্তাফিজুর রহমান প্রযোজিত ‘খোলা দুয়ার’, সৈয়দ শামসুল হক রচিত, ড. রাজীব হুমায়ুন রচিত ও খ ম হারুন প্রযোজিত ‘নীলপানিয়া’, জুবাইদা গুলশানারা রচিত ও শেখ রিয়াজদ্দিন বাদশা প্রযোজিত ‘সাগর সেচার সাধ’, কাজী মাহমুদুর রহমান রচিত ও আতিকুল হক চৌধুরী প্রযোজিত ‘স্বর্ণতোরণ’, বেগম মমতাজ হোসেন রচিত ও খ ম হারুন প্রযোজিত ‘শুকতারা’, আহমেদ মুসা রচিত ও আতিকুল হক চৌধুরী প্রযোজিত ‘চানমিয়ার নেগেটিভ পজিটিভ’ এবং জিয়া আনসারীর ‘জীবনের অপর পাতায়’।

নব্বইয়ের দশকেও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বেশকিছু নাটক প্রচারিত হয়। এর মধ্যে মাহবুব জামিল রচিত ও খ ম হারুন প্রযোজিত ‘অচেনা বন্দর’ নাটকটি বেশ প্রশংসিত হয়। একজন প্রকৌশলীর যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং ফিরে এসে স্ত্রী-সন্তানকে হারিয়ে নিঃস্ব জীবনযাপনের করুণ চিত্র ফুটে ওঠে এতে। ‘স্মৃতি বর্তমান’ নামে শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের ভিন্ন ভিন্ন কাহিনি যোগ করে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধারার নাটক উপহার দেন খ ম হারুন। নব্বই দশকে উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে আরও ছিলÑ সাইফুল বারী রচিত ও জিয়া আনসারী প্রযোজিত ‘জোনাকী জ্বলে’ এবং আমজাদ হোসেন রচিত ও জিয়া আনসারীর প্রযোজনায় ‘জন্মভূমি’। বিটিভিতে প্রচারিত আরও কিছু নাটক দর্শকের মনে দাগ কেটে আছে। এর মধ্যে রয়েছেÑ কাজী মাহমুদুর রহমান রচিত ও শেখ রিয়াজউদ্দিন বাদশা প্রযোজিত ‘সন্ধান’, আবদুল্লাহ আল মামুন রচিত ও প্রযোজিত ‘আয়নায় বন্ধুর মুখ’, মামুনুর রশীদ রচিত ও আবদুল্লাহ আল মামুন প্রযোজিত ‘আদম সুরত’, আতিকুল হক চৌধুরী রচিত ও প্রযোজিত ‘পটভূমি পরিচিতি’ ও ‘নীল নকশার সন্ধানে’, সেলিনা হোসেন রচিত ও জিয়া আনসারী প্রযোজিত ‘যাপিত জীবন’, আরেফিন বাদল রচিত ও আলী ইমাম প্রযোজিত ‘ঐ আসে আমীর আলী’, মামুনুর রশীদ রচিত ও মুস্তাফিজুর রহমান প্রযোজিত ‘ধল প্রহর’, জিয়া আনসারীর ‘জীবনের অপর পাতায়’ প্রমুখ।

এর পর ধীরে ধীরে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বাড়লেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নাটক নির্মাণ কমতে থাকে। নির্মাতা মাসুদ সেজান এজন্য অন্যতম কারণ হিসেবে বাজেটকে দায়ী করলেন। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হয়। বিষয়টি অনেক কষ্টসাধ্য আর বাজেটের ওপর নির্ভর করে। টিভি নাটকে সেই বাজেট পাওয়া যায় না।’ গুণী নির্মাতা গাজী রাকায়েত অবশ্য বাজেটের পাশাপাশি মেধাশূন্যতাকেও দায়ী করছেন। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়টুকু নাটকে সুন্দরভাবে তুলে ধরার জন্য ভালো বাজেট প্রয়োজন। সেই জায়গাতেই আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে আমি মনে করি, মেধা থাকলে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ভালো কিছু সম্ভব। শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি এটাই যে, সেই মেধার বড় সংকট চলছে এখন। বিশেষ করে নাট্য রচনার ক্ষেত্রে।’ আরেক নির্মাতা অনিমেষ আইচ দায়ী করছেন সময় স্বল্পতাকে। তার ভাষ্যে, ‘মুক্তিযুদ্ধ একটি গবেষণানির্ভর বিষয়। এ ধরনের গল্প নিয়ে নাটক নির্মাণ করতে হলে অনেক অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে হয়। তার জন্য অনেক সময়ের দরকার। যদি ২৬ পর্বের একটি মুক্তিযুদ্ধের নাটক আমাকে বানাতে দেওয়া হয়, তা হলে এক বছরের প্রস্তুতি প্রয়োজন। সঙ্গে প্রয়োজনীয় টাকাও দিতে হবে।’

গাজী রাকায়েত

মেধা থাকলে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ভালো কিছু সম্ভব। শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি এটাই যে, সেই মেধার বড় সংকট চলছে এখন

মাসুদ সেজান

মুক্তিযুদ্ধের সময়কে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হয়। এজন্য প্রয়োজন ভালো বাজেট। কিন্তু সেটাই পাওয়া যায় না

অনিমেষ আইচ

মুক্তিযুদ্ধ একটি গবেষণানির্ভর বিষয়। এ নিয়ে নাটক নির্মাণ করতে অনেক অ্যারেঞ্জমেন্টের প্রয়োজন। ফলে অনেক সময়ের দরকার